গরীবের ভালবাসা
![]() |
গরীবের ভালবাসা - Green Vivacity |
– দুপুরে খেয়েছো?
– নাহ, রান্না হচ্ছে। একটু পর খাবো।
– ৩ টা বাজে এখন। কখন তোমার রান্না শেষ হবে আর কখন তুমি খাবে।
– হয়ে যাবে। তুমি খেয়েছো?
– তোমার খাওয়ার আগে আমি কখনো খাই?
– আজ খেয়ে নাও। আমার লেট হবে।
অঙ্কুশ ফোন রেখে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। শরীর চলছেনা আর। গত রাত থেকে এখনো পেটে কোন খাবার যায়নি।বাসায় রান্না হয়নি। মেসের রুমমেটরা দুপুরে কেউ বাসায় খায়না। সবাই অফিসে চলে যায়। বাজার হয়নি সকালে।পকেটেও কোন টাকা নেই। এই মেসে অঙ্কুশই কেবল একমাত্র বেকার মানুষ।সারাদিন বই পড়ে। এই গল্প টল্প পড়ে অথবা দু একটা কবিতার বই।বাসা থেকে মাসে ৩০০০ হাজার টাকা আসে। বাবা নেই, মা বাসায় বসে সেলাই টেলাই এর কাজ করে যা উপার্জন করে, তা দিয়ে সংসারটাকে টেনেটুনে নিয়ে যাওয়াই কঠিন হয়ে যায়।তারপরও সেই কষ্টের টাকা থেকে, এই টাকাটা তাকে পাঠাতে হয়।
যদিও ৩০০০ টাকার মধ্যে ২০০০ টাকা চলে যায় সিট ভাড়াতে আর বাকি ১০০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা মেসের বুয়ার বিল।মেসে থাকতে হলে ওয়াইফাই এর বিল ১০০ টাকা দেওয়া বাধ্যতামূলক!যদিও অঙ্কুশ এর এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন অথবা ল্যাপটপ কিছুই নেই, তবুও দিতে হয়।জগতের যে কত নিয়ম ফলো করে টিকে থাকতে হয়!ক্ষুধায় অঙ্কুশের শরীর দুমড়ে মুচরে যাচ্ছে। পেটের ভেতর গ্যাস বুদবুদ শব্দ করে ফেপে উঠছে।পেট ফুলে গেছে, অথচ পেটে কোন খাবার যায়না প্রায় ২৮ ঘন্টা!গলির মোড়ের যে চায়ের দোকানটা, সেখানে ২৩৫ টাকা বাকি জমেছে।কলা রুটি খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু যাওয়ারই তো সুযোগ নেই।
অনুরিমা আবার ফোন দিয়েছে।
– খাওয়া হলো তোমার?
– হ্যা হয়েছে। খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম, গুনে গুনে ২ প্লেট ভাত খেয়েছি। তুমি খাওনি এখনো?– নাহ, এখন খেতে যাবো। খেয়ে এসে তোমাকে কল দিচ্ছি।– আচ্ছা খেয়ে নাও।অনুরিমা ফোন কেটে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে কান্না করছে। সে জানে, অঙ্কুশ এখনো কিছু খায়নি। প্রিয় মানুষের কন্ঠস্বর শুনলে তার না বলা কথাও বুঝা যায়।অনুরিমার সামনে ভাতের থালায় খাবার পড়ে আছে। কাছের মানুষ না খেয়ে আছে জানার পর কি করে গলা দিয়ে খাবার নামে ? অনুরিমা তার খাবারগুলো একটা বক্সে ভরে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। অঙ্কুশের বাসার গেটে এসে তাকে ফোন দিয়ে নিচে নামতে বললো। অঙ্কুশ নিচে নেমে দেখে অনুরিমা দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা টিফিন বক্স।
সামনে আসতেই অনুরিমা বক্সটা অঙ্কুশের হাতে দিয়ে বললো, আজ শোল মাছের ভর্তা আর শিং মাছের ঝোলটা ভালো হয়েছে।আমি একা একা খাবো, এটা মানতে পারছিলাম না। তুমি তো দুপুরে খেয়েছো, এটা রাতে খেও। আর উপরে যেয়ে ফ্রেস হয়ে বের হও।পাক্কা ১০ মিনিট সময় আছে তোমার হাতে। ১ মিনিটও যাতে লেট হয়না।ব্যাচেলর মেসে থাকা ছেলেদের রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হতে ২ মিনিট লাগে। এর আগেও অনুরিমা কখনো ২ মিনিটের বেশি সময় দেয়নি। আজ ১০ মিনিট সময় দিয়েছে।অঙ্কুশ বুঝতে পারছে, এটা আসলে তার ভাত খাওয়ার সময়।সে ভাত খেয়ে নিচে নেমে দেখে অনুরিমা গেটের পাশে নেই।অঙ্কুশ তাকে খুঁজতে খুঁজতে অনেকদূর চলে এসেছে। কোথাও অনুকে দেখা যাচ্ছেনা।সে অনুর ফোনে কল দিতে যেয়ে দেখলো ব্যালেন্স নেই। ব্যাচেলর মেসে থাকা দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের ফোনে সবসময় ব্যালেন্স থাকে না।
একটু পর অনুরিমা ফোন দিয়েছে। অঙ্কুশ ফোন ধরেই বললো,
– এ্যাই অনু, কোথায় চলে গেলে?
– বাসায়।
– বাসায় মানে?
– বাসায় একটু কাজ আছে! জরুরী কাজ!– কি এত জরুরী কাজ? না বলেই চলে যেতে হয়?
– পরে বলি?– আচ্ছা বইলো।– তুমি খেয়েছো?অঙ্কুশ কোন জবাব দিল না। কারন ওপাশ থেকে অনুরিমা কান্না করছে।একদম হাউমাউ টাইপ কান্না। মনে হচ্ছে, এখনি বোধয় তার দমবন্ধ হয়ে আসবে।অঙ্কুশ দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে, অনু ? কাঁদছো কেন? কেউ কিছু বলেছে? আমি কিছু করেছি ?
– নাহ, তুমি কিছু করোনি। এমনিই কাঁদছি।– এমনিই কেউ কখনো কাঁদে ?
– আমি কাঁদি তো।
– কি হয়েছে বলো আমাকে ?
– সন্ধ্যায় আমার এংগেইজমেন্ট। তোমার কথা তো বাবাকে অনেকবার বলেছি। বাবা তার মেয়েকে কোন বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিবে না।
আমি আর এসব নিতে পারছিনা, অঙ্কুশ! তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।অঙ্কুশ কি জবাব দিবে বুঝে উঠতে পারছেনা। বড়লোক বাবার আদরের সন্তান হলে হয়তো গোপনে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে যেত।যেখানে মা নিজেই ঠিকঠাক সংসারটা চালাতে পারছেনা, সেখানে হুট করে নতুন একটা মানুষকে এনে সেট করে দেওয়ার মতো অত’টা দায়িত্ব জ্ঞানহীন তো অঙ্কুশ না।ঢাকায় আসার পর কত কত চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছে। অথচ, ভালো ইন্টারভিউ দিয়েও কোন চাকরি হলো না। চাকরির ইন্টারভিউ মানেই বাস ভাড়াটা অযথা খরচ হওয়া। এই শহরে অঙ্কুশের বোধয় কোন চাকরি হবেনা। দুদিন পর অনুরিমার ফোন এলো। ভাঙা ভাঙা কন্ঠে অঙ্কুশ বললো,
– কেমন আছো, অনু ? অনুরিমা কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল,
– তোমার কি মনে হয়, আমি ভালোই আছি?অঙ্কুশ বললো,
– ভালো থাকারই তো কথা। যার স্বামী শহরের নাম করা শিল্পপতির ছেলে, তার ভালো না থাকাটা মানায়?
– অথচ, আমি তোমার সাথেই খারাপ থাকতে চেয়েছিলাম।
– জীবন আসলে এত’টা সহজ না। পৃথিবী মানুষের প্রত্যাশা পূরন করতে অপছন্দ করে। আমার সাথে থাকলে তুমি সুখী হবেনা। একটা মানুষ নিয়ে আসলে জীবন না। বেঁচে থাকতে আরো অনেক কিছুই লাগে। আমার ঘর নেই, থাকার কোন নির্দিষ্ট জায়গা নেই, ভর দিয়ে দাঁড়ানোর একটা লাঠি নেই। আমার জীবনে এসে তুমি কিছুই পাবেনা।আমি চাইনা, তুমি আমার জীবনে আসো। তুমি বরং অন্য কোথাও ভালো থাকো।ছোট্ট এই জীবনে, তোমার খারাপ থাকাটা মেনে নিতে পারবোনা।
– অর্থ সম্পদই কি জীবনের সব ? এখানে কি ভালোবাসার কোন মূল্য নেই ? এই যে আমি কাঁদছি, তোমার মায়া লাগছেনা ?
– মায়া লাগলেই সব কিছু আটকে রাখতে নেই। কিছু কিছু মায়াকে উপেক্ষা করতে শিখে গেলে, মায়াময় কিছু জিনিস ভালো থাকবে।বিয়ের ডেট কবে ঠিক হয়েছে ?
– এই মাসের ২০ তারিখ।
– ওহ, আজ তো ১২ তারিখ। আর মাত্র এক সপ্তাহ!
– তোমার মন খারাপ হচ্ছেনা ?
– নাহ। বিয়ে তো আনন্দের বিষয়। তার উপর কাছের মানুষের বিয়ে। মন খারাপ কেন হবে ?
– মন খারাপ করা লাগবেনা তোমার। আমি ফোন রাখছি।অনুরিমা ফোন রেখে দিলো। অঙ্কুশ খেয়াল করলো তার চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা জল মাটিতে পড়ে গেলো।কি আশ্চর্য !
পুরুষ মানুষ কখনো কাঁদে ? অঙ্কুশ নিজেকে বুঝাতে চেষ্টা করলো, পুরুষদের হৃদয় হবে পাথরের মতো। মৃত্যুতেও এরা কাঁদতে পারবেনা। এদের সহ্য করার ক্ষমতা হবে প্রবল। কিন্তু অঙ্কুশ নিজেকে যতই বুঝাচ্ছে, ততোই তার কান্না বেড়ে যাচ্ছে।হাউমাউ করে কান্না পাচ্ছে। কাছের মানুষের চলে যাওয়াতে কান্না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।তবুও, অঙ্কুশ তো নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। এতটুকু ব্যথায় সে কাঁদবে কেন ?আজ ২০ তারিখ।সকাল বেলায় ঘুম ভাংলো অনুরিমার ফোনে।
– হ্যালো।
– হ্যা অনু, বলো!
– দুপুরে বিয়ে।
– কনগ্রেটস!
– তুমি কি একটু আসবে?
– কোথায়?
– বিয়েতে।
– তুমি কি চাচ্ছো?
– শেষবার তোমাকে একটু দেখতাম।
– আচ্ছা আসবো।
– নীল পাঞ্জাবিটা আছে না?
– হ্যা আছে। তবে, আয়রন করা না।
– ওটাই পড়ে এসো!
– আসবো।
অনুরিমা ফোন রেখে দিলো। অঙ্কুশের জীবনের সবচেয়ে কঠিন এবং কষ্টের দিন আজকে। তবুও সে কাপরের স্তুপ থেকে নীল পাঞ্জাবীটা বের করে পানি দিয়ে আয়রন করে নিলো।পাশের রুমমেটের কাছ থেকে একটু পারফিউমের ঘ্রাণ মাখিয়ে নিলো।অঙ্কুশ বাসা থেকে বের হয়ে সোজা কমিউনিটি সেন্টারে গেলো। কমিউনিটি সেন্টারের নাম আনন্দ কমিউনিটি সেন্টার।যদিও এখান থেকেই অনেক মানুষের বেদনার গল্প শুরু হয়।ফুল দিয়ে সাজানো একটা স্টেজে অনু বসে আছে। কি পরীর মতো লাগছে মেয়েটাকে।অঙ্কুশ বুঝতে পারছে ঝলমলে আলোর স্টেজে বসা মেয়েটার ব্যাকস্টেজে অন্য একটা মানুষ।এই মানুষটা সে নিজেই।
কখনো নিজের প্রেমিকার বিয়েতে প্রাক্তন প্রেমিক দাওয়াত খেতে আসে, এরকম কিছু অঙ্কুশ কখনো শুনেনি।এত বড় স্পর্ধা প্রেমিকদের হয়না।অঙ্কুশ স্টেজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কুচকানো পাঞ্জাবি দেখে তেমন কেউই পাত্তা দিচ্ছে না। ক্যামেরাম্যান বললো- এ্যাই ভাই চাপেন তো। দেখেন না ছবি তুলতেছি।অঙ্কুশ হাসতে হাসতে সাইডে চেপে গেলো। অনুরিমা কিছু বলতে পারছেনা।ক্যামেরা ম্যান হাসতে বললে, অনুরিমা হাসে। ক্যামেরা ম্যানরা কখনো কাঁদতে বলে না। কাঁদতে বললে, এই মুহূর্তে অনু জন্মের কান্না কাঁদতো।
একটু পর অঙ্কুশ স্টেজে উঠে অনুরিমার আর তার স্বামীর পাশে বসে অনুরিমার সাথে শেষ দেখা করে এলো।চলে আসার সময় অনুরিমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলে আসলো, তোমার বিয়ের উপহার!চলে আসার সময়, অঙ্কুশ পেছনে তাকিয়ে একটা অতৃপ্তির হাসি দিলো।অনুরিমা তাকাচ্ছে না। তাকালেই হয়তো কেঁদে ফেলবে।বাসর ঘরে ঢুকে অনুরিমা অঙ্কুশের দেওয়া খামটা খুললো।খামের ভেতর কম্পিউটারে কম্পোজ করা বোল্ড লেটারের একটা চাকরির এপোয়েন্টমেন্ট লেটার।
● "গরীবের ভালবাসা" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না । আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
No comments