স্মৃতির খোঁজে
![]() |
স্মৃতির খোঁজে - Green Vivacity |
অফিস টাইমের ভিড়টা দমদম স্টেশনে আছড়ে পড়ে। এ সময়টা বল্টুদের ব্যবসার সময়। সবাই ছুটে চলে সুরঙ্গর দিকে। মেট্রো করে অনায়াসে পৌঁছে যাবে যে যার কাজের জায়গায়।
বছর চোদ্দর বল্টু কাজটা ভালোই শিখেছে। পকেট কাটা বা মোবাইল তুলে নেওয়া ওর কাছে জলভাত। সকালের দিকেই ওর ইনকামের কোটা পূর্ণ হয়ে যায়। রফিক ভাই রোজ রাতে কালেকশনে আসে। ওর হাতে দিয়েও বেশ কিছু থেকে যায় বল্টুর। জুয়া খেলে আর ডেনড্রাইটের নেশা করেই বাকি সময়টা কাটে। কখনো আবার মনটা ফুরফুরে থাকলে একটু সিনেমা দেখতে যায়। তবে আজকাল টিকিটের যা দাম !
ভোর বেলা প্রথমে স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে মায়েদের ভিড় হয়। এদের কাছে বিশেষ মাল থাকে না। তবে স্কুল ড্রেস পরা ফিটফাট বাচ্চা দেখতে দেখতে স্মৃতি হাতড়ায় বল্টু। এদের দেখলে মনটা কেমন যেন করে। একটা চাপা হিংসাও হয়। অসহায় লাগে খুব !! ওদের জীবন কেন এমন এই প্রশ্নটা মাথায় ঘোরে শুধু !!
এরপর অফিস যাত্রীদের ভিড়। এটাই বেশ ভালো সময় বল্টুর জন্য।একবার একটা ল্যাপটপ পেয়ে গেছিল ভাগ্যের কৃপায়। সন্ধ্যায় ও ভালোই হাত মারা যায়।
আজ ভালোই দাও মেরেছে বল্টু, তিনটে পার্সেই বেশ করকরে নোট, দুটো বেশ ঝাঁ চকচকে ফোন!! টাকাটা প্যান্টের লুকানো পকেটে পাচার করে ফোন দুটো সুইচ অফ করে ও পৌঁছে যায় ওর রেললাইনের ধারের ঝুপড়ির পাশের আস্তানায়। ভালো করে ফোন দুটো দেখে। বেশ দামী জিনিস বোঝা যাচ্ছে। সাবধানে সিম বার করে ফেলে দেয় । ভগার দোকানে দিলে ও সব ভেতরের মাল সাফ করে পুরো নতুন করে দেবে। বল্টুর অনেক দিনের শখ নিজের একটা এমন দামী ফোনের, যেটায় ঐ জিও ভরে ও সিনেমা দেখবে।
আজকাল সবার ফোন আছে। রাখুর ফোনে কত কি ইন্টু মিন্টু দেখে ওরা । এই একটা ফোন যদি রফিক ভাইকে লুকিয়ে ও নিজের করে নিতে পারে.....!!
তবে ভগাকে বলে সিম নিতে হবে। তার আগে ফোনটা যাতে পুলিশে না ধরে তার জন্য ভগা কি সব করবে । খরচা আছে !!
রফিক ভাই কে ফাঁকি দেওয়াও বেশ কঠিন। ওর চোখ না ঐ কি যেন বলে.... ইসকেনিং মেশিন মাইরি!! সব ধরে ফেলে। একটা বিড়ি বের করে সুখটান দেয় কিশোর বল্টু।
আসলে ঐ যে এনজিওর দিদিটা আসে মাঝে মাঝে, কি সুন্দর দেখতে...... ঠিক যেন সিনেমার ঐ মেয়েগুলোর মত, রিয়া দি। একটা ফোন থাকলে ঠিক দিদিটার সাথে মাঝে মাঝে কথা বলা যেত। দিদিটাকে দেখলেই মনটা কেমন হয়ে যায় বল্টুর। দিদিটা মাঝে মাঝে আসে, ওদের কত ভালো ভালো কথা বলে। গতবার পূজায় সবাইকে জামা প্যান্ট দিয়েছিল। বল্টুকে একটা বেশি জিনসের প্যান্ট দিয়ে বলেছিল -"তোর মতো আমার একটা ভাই আছে।"
ঐ প্যান্টটা বল্টু সিনেমা হলে গেলে পরে। রিয়াদিকে রফিক-ভাই পছন্দ করে না । রফিকের কাজ ভণ্ডুল হয়। ওরা এলেই ব্যবসা বন্ধ। এই স্টেশনের সবাইকে রফিকের কথা মত চলতে হয়। ওকে দৈনিক হিস্যা না দিয়ে কেউ এই চত্বরে থাকতে পারবে না। থানা থেকে সরকারের ঘর , ওর পরিচিতি সব জায়গায়।
আপাতত ফোন দুটো লুকিয়ে রাখে বল্টু ওর গোপন জায়গায়। কয়েকটা নোট ও লুকিয়ে ফেলে। ফোনটা নিজের করে নিতে খরচা আছে !! আগে জমুক কিছু। তিন বছর আগে একবার একটা ফোন রফিক ভাইকে না দিয়ে নিজেই বিক্রি করতে গেছিল বল্টু। রফিক মেরে ওর হাত ভেঙ্গে দিয়েছিল। কেউ আসে নি ওকে বাঁচাতে। তখন ও ছোট ছিল, বুদ্ধিও কম ছিল। এখন চালাক হয়েছে, ও এই এলাকার এক নম্বর বলতে গেলে। ওর থেকে রফিক ভাই ভালোই হিস্যা পায়। নতুন লাইনে আসে বাচ্চাদের যে দিন বউনি হয় না বা কম আয় হয় বল্টু তাদের ও ভাগ দেয়। রফিকের হাত থেকে বাঁচায়। তাই সবাই ওকে ভালবাসে।
লাইনের পাশে একটা ঝাঁকরা বট গাছের নিচে বসে গাজা টানছিল দলের কয়েকটা ছেলে। ঐ নতুন বাচ্চাটা গোমরা মুখে ওখানেই বসে ছিল। মাত্র তিনদিন আগে রফিক-ভাই বাচ্চাটাকে এখানে রেখে গেছে। ছেড়া জামা আর কয়েকদিনের অত্যাচারে কাহিল মুখ দেখলেও বোঝা যায় বড় ঘরের বাচ্চা, ছয় সাত বছর বয়স হবে। ওকে নিয়মিত মাদক খাইয়ে স্মৃতি নষ্ট করে দিয়েছে লাইনের লোকেরা। কোথা থেকে পাচার হয়েছে কে জানে ?
রফিক বল্টুকে বলে গেছিল ছেলেটাকে লাইনে নামিয়ে নিতে। সরলা মাসির কাছে রেখেছিল ওকে। মাসি সারাদিন ঝি গিরি করে, রাতে বাচ্চাদের দেখে রাখে। ছোট মেয়েদের দালালিও করে ।
বল্টু ছেলেটাকে ডেকে নেয়। ওকে সবাই গাবলু বলে ডাকছিল, বেচারার নামও মনে নেই ঠিকঠাক। বাংলা বোঝেও না। হিন্দি বলে। বেশ গোলগাল চেহারা। এমন চেহারায় বিপদ বেশি। ওরা হয়তো এরপর ওর মুখে গভীর ক্ষত করে দেবে। এছাড়ি কতরকম নোংরামি যে এসব জায়গায় হয় বল্টু এই বয়সেই সব জেনে গেছে। সেই লাইনেও নামাতে পারে। ছেলেটা ভ্যাবলা মতো, কিছুই বোঝে না। কিন্তু মুখটা দেখলে মায়া হয়। এদের দিয়েই চলে ঐ সব ব্যবসা।
বল্টু নিজে কি করে যে হারিয়ে গিয়ে এদের পাল্লায় পড়েছিল আজ আর মনে পরে না। তবে মা এর একটা আচ্ছা অবয়ব ভেসে ওঠে মাঝে মাঝে। ঐ রিয়াদিকে দেখলে এমন হয়। ওর কথা গুলো বড্ড মা মা। আর ভাইয়ের কথা মনে পরে। দাদা দাদা করতো বড্ড। পায়ে পায়ে ঘুরত। গ্ৰামের কথা আবছা আবছা মনে আছে, একটা ষ্টেশন ছিল, ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেন যেত। লুকোচুরি খেলতে খেলতে একবার ট্রেনে উঠে পড়েছিল বল্টু । বাকি সব ধোঁয়াশা। জায়গার নাম মনে পরে না ।
কয়েকদিন গাবলুকে নিয়েই কাটল বল্টুর। ছেলেটাকে অনেক ট্রেনিং দিতে হবে। ওকে দিয়ে এখনি কাজ হবে না। ভিক্ষাও হবে না গাবলুকে দিয়ে। বড্ড গোলগাল, ফর্সা। ভয় একটাই ওকে নিয়ে !!
রাতে রফিক-ভাই আসবে। নতুন ছেলে হিসাবে কম করে পঞ্চাশ টাকাতো নেবেই গাবলুর থেকে। অথচ ছেলেটা কিছুই পারছে না। এমন চললে ওকে অন্য ব্যবসায় নামাবে রফিক।
বল্টু ওকে বলেছিল যে চুরি করে ওকে কিছু দিলে সেটা লুকিয়ে নিয়ে পালাতে আর এদিকে কোথাও লুকিয়ে যেতে। ও বোঝেই না। মেট্রো ষ্টেশনের গেটে সব সময় ভিড় থাকে। বল্টু ওকে সব বুঝিয়ে একটা লোকের পার্স তুলে ওর হাতে পাচার করে ভিড়ে মিশে গিয়ে লক্ষ্য করছিল। গাবলু পার্সটা পকেটেও ঢোকায় নি। হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে। কয়েক মিনিট পর একটা পুলিশ এসে কি বলতেই বাচ্চাটা তাকে পার্স টা দিয়ে কাঁদতে লাগলো। বল্টু পুলিশটাকে চেনে। আপাতত পার্সের আশা ছেড়ে ছেলেটাকে........
নিয়ে পালিয়ে এলো বল্টু। এমন বুর্বক জীবনে হয়নি ও।
ছেলেটা বলে কিনা চুরি করা পাপ !! সেদিন রাতে রফিক অবশ্য বিশেষ ঘাটায় নি। তবে যেমন লোলুপ দৃষ্টিতে ছেলেটাকে দেখছিল .......!! ওর যে এসব দোষ আছে বল্টু জানে। তৈরি হয়েই ছিল। একটা চকচকে ফোন রফিককে দিতেই গাবলুকে ছেড়ে রফিক বল্টুকে নিয়ে পড়ল। বেশ খুশি বোঝা যায়। বল্টুকে দেখে বলল -"এবার তোর শাটারে হাতেখড়ি করাবো ভাবছি। তোকে দিয়ে হবে। লেগে থাক।"
রাতে গাবলুকে নিজের কাছে রেখেছিল বল্টু। ভোর রাতে ঝুপড়ির ফাটা প্লাস্টিক দিয়ে চাঁদের আলো চুইয়ে ঢুকছিল। একটা ছোট বাইরে সেরে শুতে এসে বল্টু দেখে ছেলেটা ফুলে ফুলে নিঃশব্দে কাঁদছে। মনটা কেমন হয়ে যায় বল্টুর। রিয়াদির ফোন নম্বরটা খোঁজে কিন্তু কোথাও পায় না। ছেলেটাকে বাঁচাতে মন চায় কিন্তু কি করে বাঁচাবে ভেবেই পায় না। রফিক ভাই এলাকার ত্রাস। পুলিশ ওর কেনা, রাজনীতির দাদারা ওর কথায় চলে। আশেপাশে সবাই ওর লোক। এর আগে দুটো বাচ্চা পালাতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়েছিল। আসল ঘটনা বল্টু পরে শুনেছিল।
হঠাৎ ঢং ঢং করে পাশের মিশনারি স্কুলের বড় ঘড়িতে ভোর পাঁচটা বাজলো। ওখানকার ফাদার বল্টুর পরিচিত। ফাদার সপ্তাহে তিনদিন এই স্টেশনের বাচ্চাদের খাবার দেয়। উনি বলেন সবাই ঈশ্বরের সন্তান। ঈশ্বর পথ দেখাবে। রাতে ওখানে এমন ফুটপাত আর ষ্টেশনের বাচ্চাদের পড়ায় ব্রাদাররা। রবিবার করে খেতেও দেয় সব দুস্থদের। ডাক্তার দেখায়, ওষুধ দেয়। এই এলাকার কিছু বাচ্চাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফাদার হোমে রেখেছিলেন, তাই নিয়ে রফিকের সাথেও ঠাণ্ডা লড়াই চলেছিল।
যদি ওনার কাছে গিয়ে সব বলে বল্টু !! উনি নিশ্চই একটা কিছু করবেন।
ভোরের আলো ফুটতেই ফাদার মর্নিওয়াক করে ঐ বিশাল মাঠে। গেটের দারোয়ান বল্টুর চেনা। গাবলুকে নিয়ে গিয়ে ফাদারকে সব খুলে বলে বল্টু। ছেলেটা ঐ আবর্জনায় থাকলে দিনে দিনে পাকা চোর তৈরি হবে। নেশাখোর জুয়ারি হবে। একমাত্র ফাদার পারেন ওকে একটা সুস্থ জীবন দিতে।
ফাদার সব শুনে বললেন -"তোমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান। আমি দেখছি কি করা যায়।" তখনি এক ব্রাদারকে দিয়ে গাবলুকে একটা হোমে পাঠিয়ে দিলেন উনি। বল্টুকে বললেন -" তুমি ফিরলে রফিক তো তোমায় শেষ করে দেবে। তোমায় আগেও বলেছি চাইলে থাকতে পারো কোনও হোমে। পড়াশোনা করতে পারো..... ।"
বল্টু এক মনে দেখছে ফাদারের পিছনে টাঙ্গানো একটা ছবি। ওর কেমন চেনা চেনা লাগে জায়গাটা। থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফাদারকে।
"ওটা পুরুলিয়া মাই বয়। আমাদের একটা হোম রয়েছে ওখানে ......"
পুরুলিয়া নামটা ছাড়া আর কিছুই মাথায় ঢোকে না বল্টুর। নামটা চেনা চেনা......। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে ওখান থেকে। ওর মাথায় একটাই নাম ঘুরছে। পুরুলিয়া....। স্মৃতি হাতরে চলেছে ছেলেটা !!
ভগার কাছে অন্য ফোনটা বিক্রির সময় শুনে নিয়েছিল পুরুলিয়া কি করে যায়। ট্রেনটা ধানক্ষেত চিরে এগিয়ে চলেছে। নাম না জানা নদী পার হয় ঝমঝম করে। ঐ দূরে নীল আকাশে এক ঝাঁক সাদা বক উড়ে যায়। বল্টুও ওদের মত স্বাধীন। নেই কোনও রফিকের ভয়, নেই কোনও চিন্তা।আজ সে ও মুক্ত। যে দিকে চোখ যায় চলে যাবে।
● "স্মৃতির খোঁজে" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না । আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
No comments