স্বপ্ন-না-বাস্তব
![]() |
স্বপ্ন-না-বাস্তব - Green Vivacity |
রেলকলোনি মানেই কেমন গা ছমছমে পরিবেশ, ব্রিটিশ আমলের তৈরি আবাসন গুলো কেমন যেন অতীতের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, একটা নীরবতা যেন হাঁহাঁ করতে থাকে সারাটা অঞ্চল জুড়ে । কর্মব্যস্ত কর্মচারী আর তাদের পরিবার, আর প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই গাছপালা, ঝোপঝাড় যেন কেমন একটা থমথমে আবহাওয়া আর তারই মাঝে সশব্দে ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দ যা তারপরের মুহূর্তকে আরও শব্দহীন শান্ত করে দেয় ।
বাবুরা রেলকলোনি স্কুলে সেবার সরস্বতী পূজোটা একটু ধুমধাম করে করার পরিকল্পনা নিয়েছিল, সালটা ১৯৮৪। স্কুলে ছাত্রসংখ্যা সর্বসাকুল্যে শদুয়েক হবে, আর ক্লাস নাইনে বাবুদের মোট ছাত্র ছিল ৩৫ জন। যাইহোক পূজোটা একটু আড়ম্বরপূর্ণ মানে, সাউণ্ডবক্স, সারারাত গান বাজানো, বন্ধুদের ভয় দেখানো রাত জাগা .........এই আর কি ! কিন্তু কলোনির স্কুলের একটা বদনাম ছিল, এখানে নাকি ব্রিটীশ আমলে কালাপানি মানে সৈনিকদের শাস্তি দেওয়ার কুপঘর ছিল, আর তাই সন্ধ্যের পরে এদিকে কেউ খুব একটা বেশী আসতো না, বড় বড় ইউক্যালিপটাস গাছের আড়ালে স্কুলটা যেন কেমন দানবের মতো একাই দাঁড়িয়ে থাকত । সময় পাল্টেছে, দেশ অনেক এগিয়েছে, কাজেই ধীরে ধীরে সেই সব গল্প গুলোও কেমন মানুষ ভুলে যেতে শুরু করেছিল। তা স্কুলের সরস্বতী পূজো, সারারাত স্কুলে কাটাতে হবে, বেশ উদ্দীপনা ঘিরে রয়েছে বাবুদের মধ্যে, প্রথমে তো তারা প্রায় ২০-২২ জন স্কুলে রাত কাটানোর প্রোগ্রাম করেছিল, কিন্তু দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে সেটা কমতে থাকে, এবং অবশেষে পূজোর আগের রাতে সেই সংখ্যা মোট ১০ জনে দাঁড়ায়। যদিও বাবু আর রাজা দুজনের ঘণিষ্টতা একটু বেশী আর দুষ্টুমি বুদ্ধিতে একেবারে যেন মায়ের পেটের দুই ভাই, আর তাই এরকম সুযোগে দু-একজনকে ভুতের ভয় দেখাতে পারবেনা এটা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল !
যাইহোক ঠাকুরের মূর্তি এবার কুমারটুলি থেকে আনা হল আর প্যান্ডেলটাও এবার একটু অভিনব মানে দেশালাইএর বাক্স দিয়ে তৈরি হল, এব্যাপারে জিতু এক্সপার্ট । সারাদিন ধরে প্যান্ডেল সাজিয়ে সবাইকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, আর তাই যে যার বাড়ি থেকে রাতের খাবার সেরে রাত্রি ন’টার মধ্যেই স্কুলে উপস্থিত। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তাই ঠাণ্ডাও বেশ ভালোই ছিল, কাজেই সবাই বাড়ি থেকে আসার সময় একটা করে কম্বল বা মোটা চাদর সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল, আর স্কুলে এসে সবাই মিলে একসাথে শুকনো কাঠ যোগার করে আগুনের ব্যবস্থা করে ফেললো আর সেই আগুন ঘিরে সবাই গোল করে বসে শুরু হল গল্প !
শীতের রাত আর এরকম পরিবেশ, তাই গল্পও ছিল শুধু ভুত আর ভুত। গল্প করতে করতেই ঘুমের আচ্ছন্ন তাদের আরো ক্লান্ত করে তুলল আগুন নিভে আসার আগেই একটা ক্লাসরুমে ঢূকে সব ঘুমাবার প্রস্তুতি নিতে লাগল । বাবুরও খুব ক্লান্তি অনুভব হচ্ছিল, সারাদিন খুব হয়রানি গেছে তাদের, কুমারটুলি থেকে ট্রেনে বিনা টিকিটে ঠাকুর নিয়ে আসা যে কতটা কঠিন কাজ সেটা বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলে বোঝা যায়না, এদিকে রাজা বার কয়েক হাই তুলে কখন নেতিয়ে পড়েছে, কিন্তু এরকম সুযোগ বারে বারে আসেনা, বাকি বন্ধুদের মুখগুলো দেখে বাবুর ভিতরটা উশখুশ করে উঠল, কিন্তু শরীরও যে চলছেনা, এমন সময় বাবু হটাত লক্ষ্য করল যেন স্কুলের রুমগুলো কেমন পাল্টে গেছে !
সব ঘর গুলো কেমন সারি সারি খুপরির মতো দাঁড়িয়ে আছে, তার বন্ধুরা সবাই হটাৎ করে কোথায় উধাও হয়ে গেল, লাইট তো দুরের কথা চারিদিক কেমন অন্ধকার । শুধু প্রতিটি খুপরির বাইরে সেজবাতির মতো টিমটিম করে আলো জ্বলছে ! বাবুর বুকের ভিতরটা শুকিয়ে এল । সে যে ঘরটায় ছিল সেটাও উধাও, সামনে একটা বড় গেট, একটু দুরেই চিকচিক করে আলো জ্বলছে ঝাঁকে ঝাঁকে । বাবু একটু চোখটা রগরে দেখল সেগুলো সব ভয়ঙ্কর শেয়াল আর হায়েনার দল ! যেন কিছু খাবারের লোভে তারা অপেক্ষা করছে। বাবু ধীরে ধীরে গেটের দিকে এগিয়ে গেল, ভিতর থেকে খুব করুণ গোঙানির আর কান্নার আর্তনাদ শুনতে পেল সে । চারিদিক গাঢ় অন্ধকার, যেন রাতের আকাশে কেউ কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখেছে, আর তারাগুলোর আলো একটা কেমন আলোআঁধারির মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে । বাবু মনের জোর নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই চমকে উঠল, একটা বড় আলো গেটের ওপরে আছড়ে পড়ল ! আর তার সাথে একটা বিকট মটরের আওয়াজ, আওয়াজটা বাবুর খুব পরিচিত, তারপরেই সে দেখল একটা জিপগাড়ি এসে গেটের সামনে দাঁড়াল, আর তার থেকে হাফপ্যান্ট আর শার্ট পড়া এক ফিরিঙ্গী নামল, সঙ্গে দুটো পেয়াদা, এরকম ফিরিঙ্গীর ছবি ইতিহাসে বা টিভির সিরিয়ালে সে দেখেছে, ভিতরের গোঙানির আওয়াজটা হটাৎ করে থেমে গেল, একটা হিমেল নিস্তব্ধতা চারিদিকে। বাবু ধীরে ধীরে ওই ফিরিঙ্গীকে অনুসরণ করল । ভিতরে ঢুকে বাবু আরও চমকে উঠল, প্রতিটি খুপরির ভিতরে সে একজন-দুজন করে লোককে দেখতে পেল , তাদের শরীরে বস্ত্র নাই বললেই চলে , উষ্কখুষ্ক চেহারা কিন্তু বজ্রের মত কঠিন। মুখের গড়নও অনাবশ্যক রকমের বড়ো, অতিরিক্ত রকমের মজবুত চোয়াল, চিবুকের হাড় যেন দুর্গদ্বারের কঠিন পাটাতনের মতো পেটানো, চোখ গুলো খুব ভয়ঙ্কর লাল আর তীক্ষ্ণ ।
চওড়া কপালটা কানের ধনুকের মতো বেঁকে রয়েছে । তার উপরে নাকটা টিলার মতো দাঁড়িয়ে আছে, তাদের দৃষ্টি যেন তীরের ফলার মতো এবং তাতে বিদ্যুতের মতো ঝলকানি । হাতগুলো সবার মোটা লোহার শেকল দিয়ে পেছন দিকে বাঁধা । বাবুর চোখ চলে গেল একটা পাশের খুপরিতে, সেখানে তখনও একটা হালকা গোঙানির শব্দ সে শুনতে পাচ্ছিল, বাবুর বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল, সে দেখল সেখানে ওরকমই একটা বীর হাতপা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে, সারা শরীর দিয়ে রক্ত চুইয়ে পড়ছে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে, ফিরিঙ্গী সেইখানেই এসে দাঁড়াল, একটা লোহার চাবুকের মতো কিছু নিয়ে তাকে পেটাতে শুরু করল, যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সেই লোকটি বাবুর দিকে তাকাল, খুব ভয়ঙ্কর সেই চাহুনি, বাবুর বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেল । তারপরে সে অবাক হয়ে দেখল সেই দুইজন পেয়াদা টানতে টানতে সেই আহত যন্ত্রণাক্লিষ্ট লোকটাকে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলে ফেলল আর সেই হায়েনা গুলো যেন এই সময়ের অপেক্ষায় ছিল, সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই আহারের ওপরে !
বাবু স্কুলে পড়েছে ফিরিঙ্গীদের অত্যাচারের কথা, নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা, কেমন করে নিশ্রংস বেতের আঘাতে গরিব চাষীদের পিঠের চামড়া তুলে নিয়ে কোমড়ে দড়ি বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখত তাদের, কেমন ভাবে কালাপানির দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের নির্মম অত্যাচার করত এই ফিরিঙ্গীর দল, কিন্তু এই দৃশ্য যেন তার চেয়েও ভয়ঙ্কর । বাবুর বুকের ভিতরটা একটা অজানা কষ্টে ছটফট করতে থাকে, সে সেখান থেকে পালাবার চেষ্টা করে কিন্তু সে শত চেষ্টা করেও সেখান থেকে নড়তে পারেনা ! ছোটো ছোটো খুপরির পাশেই সে একটা তুলনামূলক বড় এবং উজ্জ্বল কুঠুরি দেখতে পায় । সেখান থেকে সে তবলা আর হারমোনিয়ামের শব্দ শুনতে পায় ! বিস্ময়ে হতবাক বাবু সেইদিকে এগিয়ে যায় । সে অবাক হয়ে দেখে সেখানে কিছু মেয়ে সেই একই ভাবে হাতপা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে ! আর কেউ তাদের জোর করে নাচতে বাধ্য করছে, আর সেই নিষ্টুর ফিরিঙ্গী সেখানে বসে বসে অট্টহাসি হাসছে । বাবুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসে, এমন সময় বাবু তার পিঠে একটা হাত অনুভব করে, বরফের মতো শীতল সেই হাত । বাবু মুখ ফিরিয়ে দেখে এক প্রায় আশি ছুঁইছুঁই বৃদ্ধ, সে তার দিকে চেয়ে আছে ।
বাবু কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয়না । বুড়োটা আঙ্গুলের ইশারায় তাকে চুপ করতে বলে । তারপর ফিসফিস করে তার কানে কানে বলে । আর কতদিন সইব এ জ্বালা ! আর কত প্রাণের বিনিময়ে আমার দেশমাতা হবে শৃঙ্খলমুক্ত । আমার সারা দেশের ভাইবোন স্বাধীনতার সূর্য দেখবে ! বাবু ভয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেই । সে শুনতে পাই এক ভয়ঙ্কর অট্টহাসি, সব গোঙ্গানির শব্দ হটাৎ এক প্রেতলোকের হাসিতে ভরে যায় ! বাবুর হাত পা নিস্তেজ হয়ে আসে, তার দম বন্ধ হয়ে আসে, সে খুব জোরে চিৎকার করার চেষ্টা করে, সে আপ্রাণ চেষ্টা করে রাজাকে ডাকার । আর তখনই সব উধাও হয়ে যায় ।
বাবু সেই রেলকলোনির স্কুলেই নিজেকে পাই ! আকাশ তখন প্রায় ফর্সা হয়ে এসেছে । বাবুর মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছিল । সে শুনেছে এই রেলকলোনির পূর্বের ইতিহাস । সে শুনেছে এই পানাগড় কে কোনো একসময় কালাপানির জায়গা বলা হত । আজকের ঘটনা তার কাছে বিস্ময়, হয়ত তার এই কথা কেউ বিশ্বাস করবেনা, হয়ত স্বপ্ন বলে সবাই উড়িয়ে দেবে, হয়ত সে সত্যি স্বপ্নই দেখেছে, কিন্তু এই অনুভুতি তার বুকের ভিতর একেবারে জীবন্ত । স্বাধীনতার বলিদান যে কতটা ভয়ানক আর নির্মম ছিল, সে যেন তার চাক্ষুষ প্রমান দেখে এল । বাবু লক্ষ্য করল তার বন্ধুরা এখনো ঘুমিয়ে । রাজাও একেবারে কম্বলে গা জড়িয়ে একধারে শুয়ে আছে । প্রচণ্ড মাথায় যন্ত্রণা অনুভব করে বাবু । সে ধীরে ধীরে উঠে যায় সেখান থেকে । এখনো তার চোখের সামনে সেই বিপ্লবীর কঠিন চাহনি টা ভাসছে । এখনো তার কানে সেই ভয়ঙ্কর অট্টহাসির প্রতিধ্বনি হচ্ছে ! বাবু কাউকে কিছু না বলে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে যাত্রা করে ।
● "স্বপ্ন-না-বাস্তব" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না । আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
No comments