দিব্যেন্দুর রচনা
![]() |
দিব্যেন্দুর রচনা - Green Vivacity |
"গুড মরররররররররনিং স্যার" পরিতোষ বাবু ক্লাসে ঢুকতেই পুরো ক্লাস সুর মিলিয়ে সমস্বরে বলে উঠলো। "মর্নিং, সবার খয়ের, বসো বসো", পরিতোষ বাবু প্রত্যুত্তরে বললেন ছাত্রদের, ক্লাসে চাপা হাসির রোল উঠল। চেয়ারে বসে সবে অ্যাটেনন্ডেসের খাতা হাতে নিয়েছেন মাত্র, সামনের বেঞ্চে বসা দিব্যেন্দু উঠে দাঁড়ালো। "এই ফার্স্ট পিরিয়ডেই হিসি ?", পরিতোষ বাবু চোখ পাকালেন। "না স্যার, হিসি না। ওটা সবার খয়ের না, সুবহ্ বখৈর। আপনি ভুল বলেন প্রত্যেকদিন", দিব্যেন্দু এই বলে বেঞ্চে বসে পড়ে। পরিতোষ বাবু হেসে ঘাড় নাড়েন শুধু, মুখে কিছু বলেন না। ৩৪ বছর ধরে পড়াচ্ছেন স্কুলে, কোনদিন কারুর সাহস হয়নি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর ভুল ধরার। হঠাৎ সরকার নিয়ম করলো স্কুলে উর্দু বলতে হবে। আরে বাবা বাঙালির ছেলে, বাপের জন্মে উর্দু বলেননি কোনদিন। হঠাৎ এসব বলতে গেলে ভুলত্রুটি হবে বৈকি ! নেহাত ক্লাসের ফার্স্ট ছেলে এই দিব্যেন্দু, তার উপর কোন এক নেতার ভাইপো। তাই কিছু বলতে পারলেন না তিনি, নয়তো এমন থাবড়া দিতেন না !
কোনমতে নাম ডেকে অ্যাটেনন্ডেসের খাতা টেবিলে রাখলেন পরিতোষ বাবু। তারপর ব্ল্যাক বোর্ডের দিকে ঘুরে চক দিয়ে বোর্ডে খসখস করে আজকের তারিখ আর "বিষয়- বাংলা" বলে লিখে ক্লাসের দিকে ঘুরলেন তিনি। সামনেই অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা, কাগজে করে তাই পরীক্ষায় আসা সম্ভাব্য রচনাগুলোর লিস্ট লিখে এনেছেন। শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ থেকে তাঁর ভাঁজ করা কাগজটা বের করতে করতে ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে থেকে সায়নকে ডেকে নিলেন তিনি। সায়নের মাথা বেশ ভালো পড়াশোনায়, কিন্তু প্রচন্ড দুরন্ত। আজ কার গাছ থেকে আম পাড়ছে, তো কাল কার ব্যাগে আরশোলা রাখছে। এই তো সেদিন ব্যাটা বাড়ি থেকে লুকিয়ে অ্যালান মুরের "ভি ফর ভেন্ডেটা" বইটা এনে ছেলেগুলোকে পড়াচ্ছিল। ভাগ্যিস তিনি দেখতে পেয়ে এসে বুঝিয়ে সায়নকে আর এই বই স্কুলে আনতে বারণ করে দিয়েছিলেন। নয়তো স্কুলের প্রিন্সিপালের হাতে পড়লে সোজা "ঘেউবিবাদী" তকমা দিয়ে পুলিশে পাঠাতো।
সায়নকে ডেকে পরিতোষ বাবু বললেন, "কাগজে যা লেখা আছে, জোরে জোরে পড়তে থাক।" "আর এই যে তোরা খাতা বের করে লেখ ও যা বলছে।" ক্লাসের ছাত্রদের নির্দেশ দিয়ে তিনি নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। পাঞ্জাবির খুঁটে চশমাটা একবার মুছে নিয়ে ব্যাগ থেকে ব্যাকরণের বইগুলো এক এক করে বের করতে লাগলেন। সায়ন জোরে জোরে পড়তে থাকল, "আগামী অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় আসা সম্ভাব্য রচনাবলী.......... (এক)-- মানুষের জীবনে বিজ্ঞান, (দুই)-- বিশ্ব বাংলা, (তিন)-- তোমার জীবনের লক্ষ্য, (চার)-- শিল্প ও ভারতবর্ষ, (পাঁচ)-- গরু, (ছয়)-- বিদেশভ্রমনের উপকারিতা, (সাত)-- তোমার প্রিয় কবি ।" সায়ন পুরোটা পড়ে আবার কাগজটা ভাঁজ করে পরিতোষ বাবুর হাতে দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। পরিতোষ বাবু বললেন, "এই কটা ভালো করে পড়, ক্লাসের বই ছাড়াও বাইরের বইয়ের সাহায্য নিতে পারিস। আগে নিজেরা একটা করে লিখে এনে আমাকে দেখাবি, তারপর আমি কারেকশন করে দেব, কেমন ? নিজেরা লেখার চেষ্টা না করলে শিখতে পারবি না কিছু ।" এই বলে পরিতোষ বাবু বাংলা ব্যাকরণের বইটা খুলে পড়াতে শুরু করলেন। ঘন্টা পড়ার পর ক্লাস থেকে বেরোনোর সময় বলে গেলেন, "কাল সবাই নিজেদের হোমওয়ার্ক খাতায় পছন্দমতো একটা করে রচনা লিখে আনবি, খাতা দেখব কিন্তু সবার ।"
পরেরদিন যথারীতি ক্লাস শুরু হল। পরিতোষ বাবু একে একে সবার খাতা চেক করতে শুরু করলেন। বিজন লিখেছে, "তোমার জীবনের লক্ষ্য" বিষয়ে রচনা। সে বড় হয়ে রাজনৈতিক নেতা হতে চায়। শ্যামল লিখেছে "বিদেশভ্রমণের উপকারিতা" বিষয়ে। পরিতোষ বাবু জানেন শ্যামল এই কদিন আগেই পরিবারের সাথে ঘুরে এসেছে জার্মানি থেকে। সেই অভিজ্ঞতাকেই বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে লিখেছে সে। সায়ন খুব নিপুণ হাতে লিখেছে মানুষের জীবনে বিজ্ঞান কতটা উপকারী, সেই বিষয়ে। পরিতোষ বাবু মনে মনে হাসেন, সায়ন দুষ্টু হলে কি হবে, তার সাহিত্যজ্ঞান সম্পর্কে তিনি আগেই অবগত হয়েছেন। ক্লাসের শিক্ষকদের নিয়ে সে মজার মজার কবিতা লেখে। অন্যান্য শিক্ষকরা অসন্তুষ্ট হলেও পরিতোষ বাবুর জহুরির চোখ, তিনি বোঝেন এই দামাল ছেলের সাহিত্যজ্ঞান কতখানি। "পরে একটু দুষ্টুমি কমালেই এই ছেলে একদিন হিরের টুকরো হয়ে উঠবে", পরিতোষ বাবু মনে মনে ভাবেন। তীর্থ রচনা লিখেছে "ভারতবর্ষের শিল্প ও বাণিজ্যের ইতিহাসের উপর", তার লেখার হাতও অন্যদের তুলনায় বেশ পরিণত।
এরপর দেখেন দিব্যেন্দু রচনা লিখেছে "তোমার প্রিয় কবি'র উপর ।" পরিতোষ বাবু হাসিমুখে পড়তে শুরু করলেন তার রচনা,
"ছেলেবেলার একটি মধুর স্মৃতি আজও আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দেয়। আমি ঘুমিয়ে আছি আর বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আবৃত্তি করছেন,
'তোমার নাম ? সি ইউ বাই
বাবার নাম ? হ্যালো-হাই
মায়ের নাম ? সুইটি পাই
বোনের নাম ? হাই ফাই'
আমি মনে মনে ভাবতাম আমার বাবা কি সুন্দর কবিতা লেখেন, অবাক হতাম। বড় হয়ে জানলাম এ কবিতা তাঁর লেখা নয়, এই কবিতা লিখেছেন মায়া মুখার্জি। এরপর একে একে মুখস্থ করে ফেললাম "হাম্বা", "থ্যাংক ইউ", "ওপাং এপাং ঝপাং" সহ আরো অনেক কবিতা। তাঁর লেখা "বিকেলটা হারিয়ে গেছে", "কথাঞ্জলি" প্রভৃতি অনেক বই আমি পড়েছি। কিন্তু বাড়িতে অতিথি এলেই তাদের আমি এই কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনাতাম,
'খেতে ভালো আলুর দম
ঝাল বেশি টক কম।
ভাতের বদলে চপ
গপগপ করে খায় সব।'
সাহিত্য আমার বরাবরের প্রিয় বিষয়। তাই সুকান্ত, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ যতটুকু পেরেছি পড়েছি। কিন্তু একইসাথে দেশপ্রেম, শাশ্বতপ্রেম, মানবতা, বিদ্রোহ আর সম্প্রীতির অপূর্ব সম্মিলন আমি আর কারোর লেখায় এরকম ভাবে পাইনি। তিনি শিখিয়েছেন 'ভালোবাসা শুধু এক অর্থে হয় না, টিচার, ঠাকুর, পরস্পর বন্ধুবান্ধব, ছাত্রছাত্রী' সবাইকে নিয়ে হয় ভালোবাসা। আমার কাছে তিনি সত্য, কল্যাণ, সুন্দরের স্বপ্ন দেখা মানুষ।
'আতা পাতা খাতা
পেন্সিল পেন রবার।
দিন থেকে হয় রাত
নেই ছুটি এদের সবার।
বাদল অদল বদল
উল্টোপাল্টা কেবল।
চল দেখি ইস্তাম্বুল
পাঠান দেখবে রসুল।'
একটি কবিসত্ত্বায় এত বিচিত্রতার সমাবেশ আমায় মুগ্ধ করেছে। আমার সবসময় মনে হয় বাংলা সাহিত্যে মায়া মুখার্জির অবদান লিখে শেষ করা যাবে না। এই আর্ত-পিড়িত মানবতার কবি নিজের জীবনে অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত এভাবেই অনেক কষ্টে তিনি বেঁচে ছিলেন। নইলে বাংলার সাহিত্যাঙ্গন আরো কত সমৃদ্ধ হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি লিখেছিলেন,
'অঙ্কন কঙ্গন রঙ্গন
বাড়িওনা বেশি ওজন।
অঞ্জনা রঞ্জনা কাঞ্চনা
মিষ্টি চানাচুর খায়না।
সৌগত সুব্রত পার্থ
সদা বলে সত্য।
বক্সি, মিত্র, গায়েন
সবার বন্ধু ও'ব্রায়েন।
সত্যিই তো, যে বিদ্রোহ করবে, সেই তো ভালোবাসবে। মায়া মুখার্জি পূর্ণতার স্বপ্ন দেখা মানুষ। তাই তিনিই আমার প্রিয় কবি ।"
রচনাটা পড়ে চশমাটা নাকের ডগায় একবার চেপে ধরলেন পরিতোষ বাবু , তারপর ঘাড়টা একবার পিছনে একবার সামনে করে দিব্যেন্দুকে ডাকলেন নিজের কাছে। পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "এই রচনাটা কে লিখিয়ে দিয়েছে তোমায় ?" দিব্যেন্দু আমতা আমতা করে বলল, "আজ্ঞে আপনি যে বলেছিলেন অন্য বইয়ের সাহায্য নিয়ে লিখতে। তাই আমি...", আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, হঠাৎ উড়ন্ত চাকতির ন্যায় কিছু একটা সপাটে তার মাথায় এসে লাগল। পরিতোষ বাবু তখন রণচন্ডী মূর্তি ধারণ করেছেন। দিব্যেন্দুর মাথায় মোক্ষম একটা গাট্টা মেরে তিনি বললেন, "হতচ্ছাড়া, এটা নাকি ক্লাসের প্রথম ছাত্র ! নজরুলের উপর লেখা রচনা হুবহু টুকে তাতে মায়া মুখার্জির নাম আর কবিতা দিয়ে লিখে এনেছিস হারামজাদা !! এত ভালো কবিরা থাকতে শেষে কিনা মায়া মুখার্জি তোর প্রিয় কবি ! আজ তোর মাথায় আমি কথাঞ্জলি ভাঙব।"
পরিতোষ বাবুর এই মূর্তি ছাত্ররা আগে কোনদিন দেখেনি। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে পাশাপাশি ক্লাসের সব শিক্ষক-শিক্ষিকারা পরিতোষ বাবুর ক্লাসে ছুটে এলেন। স্কুলের প্রিন্সিপাল নিজের অফিসে বসে সবেমাত্র মায়া মুখার্জির "চোখের তারা" বইটা পড়তে শুরু করেছিলেন, তিনিও বই-টই ফেলে পরিতোষ বাবুর ক্লাসে দৌড়ে এলেন। পরিতোষ বাবু তখন একের পর এক গাট্টা দিব্যেন্দুর মাথায় সমানে মেরেই চলেছেন, আর বলছেন, "টুকতে গিয়ে জন্ম-মৃত্যু সালও পরিবর্তন করেনি হারামজাদা ! পরিবর্তন ওদের রক্তে আছে নাকি..!" রাগের চোটে তাঁর ধুতির কোঁচা খুলে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, কিন্তু তাঁর সেইদিকে কোন হুঁশ নেই !
দিব্যেন্দু ওদিকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাট্টা খেতে থাকে আর ভাবতে থাকে, পরের বার থেকে বিদ্রোহী কবি নজরুলের বদলে রবীন্দ্রনাথের রচনাটা মুখস্থ করতে হবে !
● "দিব্যেন্দুর রচনা" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না । আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
No comments