শিশির বিন্দু
![]() |
শিশির বিন্দু - Green Vivacity |
কলকাতার ধুলো, ধোঁয়া আর শব্দ আমাকে বড় ক্লান্ত করে দেয়। আমাকে বারে বারে হাতছানি দেয় কোনো শান্ত নদীতীর, কোনো সবুজে ঢাকা গ্রাম, বিস্তীর্ন ধানক্ষেতের শান্ত বিশালতা। যেখানে গেলে আমি শুনতে পাই নিস্তব্ধতার গান। যেখানে আমি অনুভব করতে পারি, ভালবাসতে পারি প্রকৃতি মা কে।
এবার কাঁধে রুকস্যাক নিয়ে হঠাৎ ই চলে গিয়েছিলাম এক অজ পাড়াগাঁয়। নাম শান্তিপুর। জায়গাটি জয়রামবাটির একদম কাছাকাছি। আমি উঠেছি আমার বন্ধুর বাড়ি। বাড়ির সামনে বিশাল উঠোন। উঠোনের একপাশে একটি সুদৃশ্য গোয়ালঘর। সেখানে নিশ্চিন্তে সংসার করছে চারটি গরু। বাড়িটি দোতলা। মাটির দোতলা বাড়ি যে এত মজবুত ও সদৃশ্য হতে পারে আগে জানতামনা। খুব ভোরে আমার ঘুম ভাঙতো। এক হাল্কা কুয়াশার চাদর ঘিরে রাখতো সমস্ত গ্রামটিকে। আমি হাঁটতে শুরু করতাম। চারিদিকে সবুজের অহঙ্কার। চোখ জুড়িয়ে যেতো প্রকৃতির শ্যামলিমায়। আমাকে অভ্যর্থনা জানাতো বাড়ির সামনের শান্ত পুকুরটি। পুকুরে ফুটে থাকতো অজস্র শালুক। পুকুরপাড়ের এক নোয়ানো গাছ নির্দ্বিধায় প্রেম করত পুকুরের এক ছটফটে মাছের সঙ্গে। আমি একমনে বসে থাকতাম পুকুরপাড়ে আর আমার সঙ্গে সমানে গল্প করে যেত হরেক রকমের নাম না জানা পাখির দল। এক অদ্ভুত আনন্দে মনটা কানায় কানায় ভরে উঠত।
গ্রামের দুপুরগুলো মনকে বড় আরাম দেয়। এমন শুনশান নিরালা সোনালি দুপুরে আমি বসে থাকতাম পুকুরের পাশেই এক ভাঙা শিবমন্দিরে। শিবমন্দিরের সেই ঠান্ডা মেঝেতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম টেরও পেতামনা। কখনও আবার রঙ ও রেখায় ফুটিয়ে তুলতাম এই অনন্য সৌন্দর্যকে। বিকেলের পরেই আকাশে শুরু হত রঙের হোলিখেলা। একসময় নেমে আসতো বিষন্ন সন্ধ্যে। এইগ্রামটিতে এখনও বৈদ্যুতিক আলো পৌঁছয়নি। এখানে সোলার। বাজারটি বেশ আলোকময় কিন্তু বাড়ির সামনে এবং সমস্ত পাড়াটি একেবারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। এই অন্ধকার আমাদের শহুরে অন্ধকারের মত আলোআঁধারি নয়। এই নিকষ কালো অন্ধকার নিজের গভীরতাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে।
শান্তিপুর গ্রামের অধিবাসীদের মূল পেশা হল চাষবাস।এরা প্রধানত আলুচাষি। আলুর চাষ একেবারে শেয়ার বাজারের মত। কোনো বছর চাহিদা অনুযায়ী ঠিকঠাক ফলন হওয়ায় সমস্ত আলু বিক্রি হয়ে যায়। আবার কোনো বছর চাষির মাথায় হাত পড়ে। কয়েক বছর আগেই চাষিরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। কাছেই সিঙ্গুর। এইবার আমি চাষিদের মনস্তত্ব ঠিকঠাক বুঝলাম। এঁরা বংশ পরম্পরায় চাষি। কেউ হয়ত শিক্ষকতা করেন, কিন্তু তার অবসর সময়টা কাটে চাষ করে। এদের সঙ্গে জমির সম্পর্ক মা ও সন্তানের সম্পর্কের মত। এখানে চাষ করে লাভের অঙ্কটা গৌন। নিজের কিছু চাষযোগ্য জমি থাকলেই এরা আনন্দিত, নিশ্চিন্ত। সন্তানের কাছ থেকে মা কে কেড়ে নিলে সন্তান তো বিদ্রোহী হবেই।
একদিন গেলাম স্থানীয় একটি মেলায়। সাধারন গ্রাম্য একটি মেলা। বিক্রি হচ্ছে হাঁস, মুরগি এবং ছাগল। গরু ও বেচাকেনা হচ্ছে। চলছে অবাধে জুয়াখেলা।
প্রচুর ছেলেমেয়ে নাগর দোলায় চড়ছে। আমার মনে পড়ে গেল ছোটবেলাকার একটি স্মৃতি। তখন কলেজে পড়ি। নাগরদোলায় আমার পাশেবসেছে এক অচেনা তরুনী। আমরা যখন উপরের দিকে উঠে চলেছি তখন তীব্রভাবে চেপে ধরছি পরষ্পরের আঙ্গুল। আমার শরীরে তৈরী হচ্ছে ভয়ঙ্কর বিষ্ফোরন। নাগরদোলা থেকে নেমে এসে মেয়েটি আমার সিগারেটের প্যাকেটে নিজের ফোননম্বরটা লিখে দিল। তখন মোবাইল ছিলনা। ল্যান্ডফোনও সবার বাড়িতে ছিলনা। সেই সিগারেটের প্যাকেটটা অন্যমনস্কভাবে কোথায় যে ফেললাম কে জানে। মেয়েটি হারিয়ে গেল চিরদিনের মত।
পরেরদিন সকালে গেলাম জয়রামবাটি। মা সারদা ২২-১২-১৮৫৩ তে জন্মগ্রহন করেন। এই মন্দিরটি তৈরি হয় ৬ই বৈশাখ, ১৩৩০ বঙ্গাব্দে। সমগ্র পরিসরটিতে রয়েছে দুটি মন্দির। মাতৃমন্দির ও সিংহবাহিনী মন্দির। যেটা মনকে ছুঁয়ে যায় তা হল নির্জনতা। খুব বেশি মানুষের হুড়োহুড়ি নেই। জায়গাটির পবিত্রতা এখনও বজায় আছে। ধ্যানঘরের সামনে চুপ করে বসে রইলাম অনেকক্ষন।
জয়রামবাটী থেকে মাত্র ছ কিমি দুরেই কামারপুকুর। কামারপুকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মস্থান। ১৭-২-১৮৩৬ তে রামকৃষ্ণ জন্মগ্রহন করেন। ১১-৫-১৯৫১ তে ৪৫ ফুট লম্বা এই বিশাল মন্দিরটি তৈরি হয়। কিন্তু কামারপুকুরে জয়রামবাটীর পবিত্রতা নেই। এখানে বড্ড ভিড়।রামকৃষ্ণের নিজের হাতে লাগানো আমগাছটি দেখে মন ভরে যায়।
ফেরার পথে দেখলাম এক অভিনব বিষয়। এক জায়গায় তৈরি হয়েছে এক বিবাহবাসর। সেখানে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে একটি ১৪ বছরের বালক ও ৮ বছরের বালিকা। এটি আদিবাসী অধ্যুসিত এলাকা। আদিবাসী বিবাহের নিয়মানুযায়ী বিয়ে হয়ে যাবার পর কনে আশ্রয় নেবে গাছের উপর বা অন্য কোনো স্থানে সে লুকিয়ে থাকবে এবং তার স্বামী তাকে খুঁজে বের করে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবে। আদিবাসি সমাজের যে জিনিষটা ভীষন প্রশংসনীয় তা হল এঁদের নাচ গানের প্রতি ভালবাসা। আমরা মাদলের শব্দ শুনেই আকৃষ্ঠ হয়েছিলাম। শুরু হল নাচ ও গান। নাচ ও গানের মধ্যে আবাহন করা হচ্ছে প্রেমকে, ভালবাসাকে, আনন্দ ও উৎসবকে। দুই বালক বালিকা কে ঘিরে এই উন্মাদনা মনকে ছুঁয়ে গেল। এও এক ভারতবর্ষ।
যারা বেড়ানো বলতে বোঝেন উত্তাল সমুদ্র অথবা বরফে ঢাকা পাহাড় বা কোনো ঐতিহাসিক স্থান.............তাদের বলব........আপনারা বাংলার গ্রামগুলোতে বেড়াতে যান, সেখানে কিছুদিন থাকুন, গ্রামকে অনুভব করুন, দেখবেন কোন সময় যেন প্রেমে পড়ে গেছেন শ্যামল গাঁয়ের সরলতার বিশুদ্ধতার। শান্তিপুর থেকে যখন আরামবাগ যাওয়ার বাসে উঠলাম, আমার বারবার মনে পড়ছিল রবীন্দ্রনাথের সেই অমর কবিতা------
"দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুইপা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু"।
● "শিশির বিন্দু" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না । আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
No comments