সোহাগ
![]() |
সোহাগ - Green Vivacity |
"মানেটা আবার কি, দেখো মা আমি আজকে আরো ইচ্ছে করে দেরি করে যাবো। কিট্টুকে কি আমি বাপের বাড়ি থেকে এনেছি নাকি ? দাদু ঠাম্মি হওয়ার শখ আছে পুরো এদিকে নাতি সামলাবেনা। ওরা জানতো না আমি চাকরি করি ? এদিকে লোকও রাখতে দেবে না, নাতি কুশিক্ষা পাবে বলে। আমার কি কোন জীবন নেই নাকি ?" একটানা বলে যায় কথাগুলো সংযুক্তা। চুপ করে থাকেন রূপা। আদরের মেয়ে ওনার তারপর এমনিতেই মেজাজি। ওনার থেকে ভালো তো ওকে কেউ চেনে না।
ছোট থেকেই নিজের ভালোটা একটু বেশিই বোঝে। যদিও ওনারা সবসময় সঙ্গ দিয়ে এসেছেন মেয়েকে হয়ত বা ওনাদের প্রশ্রয়েই। একমাত্র মেয়ে তো তাই একটু বেশিই আদুরে। অফিস থেকে ফেরার পথে চলে আসে মাঝে মাঝেই, যদিও ওনার বলেন," দাদুভাইটা অনেকক্ষণ মাকে দেখেনা চলে যা তাড়াতাড়ি। তুই বরং ছুটির দিনেই আসিস তাহলে সবাই মিলে আসতে পারবি।" অদ্ভুত একটা ভুল বোঝাবুঝি ওদের মাঝে। এমনিতে সংযুক্তার শ্বশুর শাশুড়ি বেশ ভালো মানুষ, আর সৌম্যও একটু বেশিই হোমসিক। এইসব নিয়েই অভিযোগ সংযুক্তার। আর বোলোনা, "সারাক্ষণ শুধু ম্যা ম্যা করে যাচ্ছে। আর আমার ছেলেটাও হয়েছে তেমন সারাক্ষণ দাদান আর আম্মা।" "কি করা যাবে বল ওদের কাছেই তো ও থাকে সারাদিন।"
"তোমাকে তো বলেছিলাম মা, ওকে তোমাদের কাছে রেখেই আমি অফিস যাই। তুমি তো রাজি হলেনা। বললে বাবার পেশমেকার বসানো। আর তোমার হাঁটু ব্যাথা, তাই তোমরা পারবেনা সামলাতে। অন্যের ফেভার নিতে ভালো লাগেনা আমার।" হাসেন রূপা, "ফেভার কেন বলছিস ওদের বাড়ির ছেলে ওরা দেখবেনা ?" "না মা ওদের বাড়ির ছেলে আবার কি, আমি ওকে জন্ম দিয়েছি। এ দিক দিয়ে দেখলে আমার অধিকারই বেশি।" "ঐসব অধিকার টধিকার বুঝিনা বাবু, আমাদের দাদুভাই যত্নে বড় হচ্ছে এটাই শান্তি। একটু ঠোকাঠুকি সব সংসারেই আছে। ওনারা না থাকলে তখন বুঝবি মাথার ওপর ছাতা না থাকলে কেমন হয় ?"
নাতি সামলাতে মাঝে মাঝেই বেগ পেতে হয় সৌরভ আর সীমার, যা দুষ্টু হয়েছে ছেলেটা। নিত্য.... এই বায়না, নাহলে সেই বায়না। তবে ওই তো বাড়ির অক্সিজেন। সারাদিন ভালোই থাকে তবে ওর মায়ের আসার সময় হলেই ছেলেকে রাখা মুশকিল। কি করে যে বুঝে যায় সময়টা কে জানে। বাধ্য হয়ে তখন বৌমাকে ফোন করতে হয়। আর তাতেই সংযুক্তা ভীষণ বিরক্ত হয় ওরা বোঝেন সেটা, কিন্তু এক এক সময় নিরুপায় হয়ে করতেই হয়। সংযুক্তার মেজাজটা খারাপই ছিলো তাই আজ একটু বেশিই উত্তপ্ত কথা বলে ফেললো। যদিও ওর মা বারবার বুঝিয়ে বলেছিলেন তাও। "মামণি বাপি শোনো তোমরা রাগ কোরোনা, প্রতিদিন এত ঝামেলা আর ভালো লাগছে না আমি ওকে ক্রেশে দিয়ে দেবো। সারাদিন ওখানেই থাকবে। কারণ তোমাদের তো আবার আয়া পছন্দ নয়। একটা তো বছর, সামনে বছর স্কুলে যাবে, তারপর ওখান থেকে ক্রেশ হয়ে বাড়ি ঢুকবে।" বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে সীমা আর সৌরভের কথাগুলো শুনে। তবূও বলেন, "তোমায় কি করে বোঝাই বলতো, তোমার ফিরতে দেরি হলে কি অস্থির করে ও, মাথা খারাপ করে দেয় একেবারে।" ছেলেকে টানতে টানতে ঘরে ঢুকে যায় সংযুক্তা। কাঁদতে থাকে কিট্টু জোরে জোরে। তবুও দরজা আটকে দেয় বেডরুমের, "থাক ঘরে বন্ধ, তোর জন্য রোজ এত অশান্তি আর ভালো লাগেনা।" আজ সত্যি ছেলেটার কান্না দেখে কান্না পায় ওর। এদিকে দরজা নক করেন সীমা, "বৌমা ওকে এভাবে আটকে রেখোনা খুলে দাও।"
বাড়ি এসে আজ খুব খারাপ লাগে সৌম্যরও অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা বাড়িতে, ছেলেটা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। মায়ের মুখ ভার ওদিকে বৌয়ের চোখ ফোলা। রাতে ওর কাছে ফেটে পড়ে সংযুক্তা, "তোমরা কি চাও আমি চাকরি ছেড়ে দিই না বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করি ? তা তো আমি করবো না। দরকার হলে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো ফ্ল্যাটে, লোক রেখে ছেলে মানুষ করবো। যাদের কেউ নেই তারা কি করছে, ও সেভাবেই মানুষ হবে।" সৌম্য বোঝানোর চেষ্টা করে লাভ হয়না। খুব মন খারাপ হয় সীমা আর সৌরভেরও। বন্ধ দরজার ভেতরে কান্নায় ভেঙে পড়ে দুই নারী তাদের স্বামীর কাছে। সীমা বলে, "ওরা চলে গেলে কি করে থাকবো গো দাদুভাইকে ছাড়া। আমি থাকতে পারবোনা।" "বড় মায়াতে জড়িয়েছো সীমা, তখনি বলেছিলাম। তাহলে এত অধৈর্য হতে কেন, দাদুভাই কাঁদতো যখন ওর মায়ের জন্য কি দরকার ছিলো ওর মাকে বলার ? ওরও তো একটা জগৎ আছে।"
সংযুক্তা কাঁদলো সৌম্যর কাছে, "আমার কি আর কোন জগৎ নেই, তুমিই বলো। আমার মা বাবা অসুস্থ আমাকেও তো দেখতে যেতে হয়। কিট্টু যেমন আমার সন্তান আমিও তো ওদের সন্তান তাই না ? এছাড়া একটু বন্ধুবান্ধব ছাড়া আমি বাঁচবো কি করে বলো।" নিজের খুব কাছে টেনে নেয় সৌম্য সংযুক্তাকে, একটা কথা বলবো রাগ কোরোনা সোনা প্লিজ, "তুমি একমাত্র সন্তান বাবামায়ের, কিট্টু আমাদের সন্তান সবটা যেমন ঠিক তেমনি আমিও তো আমার বাবামায়ের একমাত্র সন্তান। ওদের প্রতিও তো আমার একটা দায়িত্ব আছে তাইনা ?" সংযুক্তার রাগ যেন আজ কিছুতেই মেটেনা, " তুমি ওদেরকে যত ভালোমানুষ ভাবো ওরা তেমন নয়। সবটা বোঝা হয়ে গেছে আমার। আসলে বৌমা মেয়ের মত হয় মেয়ে হয়না। তাহলে এত হিসেব করতে পারতো না।" "আজ দেড়বছর ধরে ওনারাই তো দেখছে ছেলেটাকে বলো।" অশান্তি বাড়তে থাকে, সংযুক্তার বাড়ির কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। রাগ করে ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। সেখানেও মা বলেন, "আচ্ছা তোর এত মাথা গরম কেন, ছেলেটা থাকতে পারবে এখানে ?" "মা তাহলে তুমিও বলছো এই বাড়িটা আর আমার বাড়ি নয় তাইতো, আমার ছেলের দায়িত্ব তোমাদের কাছেও বোঝা। আমি আয়া রেখে দেবো কয়েকটা দিন একটু সহ্য করো তারপর ফ্ল্যাট দেখছি আমি।" "মাথাটা একটু ঠান্ডা কর মা, কেন জানি তোর শ্বশুর শাশুড়িকে যেন দোষ দিতে পারছি না।"
সংযুক্তার সুখের সংসারে বড় দমকা হাওয়া এলো শুধু ভুল বোঝাবুঝি আর জেদের কারণে। সুখী সংসারী মনগুলো আজ ভালো নেই। সৌরভ আর সীমার অন্তহীন অবসর, বড় ফাঁকা বাড়িটা বাচ্চাটাকে ছাড়া। সৌম্যর শোয়ার ঘরের বিছানাটা বড় ঠান্ডা আর ফাঁকা। অফিস থেকে এসে নিঝুম বাড়িটাতে মন বসে না। অথচ মা বাবা বারবার বললে ও ইগোর লড়াইয়ে সৌম্য আর সংযুক্তা দুটো রাত ছাড়াছাড়ি আছে। আথচ ওর বুকে মাথা আর নাক না ঘষলে ঘুমই আসতোনা সংযুক্তার। হঠাৎই পরদিন রাতে ফোন আসে খুব জ্বর কিট্টুর একদম অচেতন হয়ে পড়েছে। এখানে এসে ছেলেটা একদিন খুব কেঁদেছিলো তারপর থেকে চুপ করে গিয়েছিলো। সেই রাতেই ছুটে যায় ওরা তিনজন।
দু-তিন দিন টানা চেষ্টায় সেরে ওঠে কিট্টু, এক ঝটকায় ওদের ভুল বোঝাবুঝিটা কেমন যেন কেটে যায়। সৌম্যর বুকে মাথা রাখে সংযুক্তা, বড় নির্ভরতার জায়গা ওর, কি যে হয়েছিলো মাঝে। একটু ভয়ে ভয়ে চায়ের টেবিলে বসে বলে সীমা, "একটা কথা বলবো, একটু ভেবে দেখো। ও বাড়ির দাদার শরীরটা বেশ খারাপ, দিদিও হাঁটু নিয়ে ভুগছেন। আমাদের নীচতলাটা তো খালিই থাকে। আমরা যদি সবাই একসাথে থাকি তাহলে তোমার অনেকটা চাপ কমে যাবে। আর দাদুভাই ও ঠাম্মি, দিদান আর দুই দাদুকে নিয়ে ভালো থাকবে।"
"কিন্তু এই বাড়িতে ওরা ?" অবাক হয়ে যায় সংযুক্তা, হয়ত মনটা ভালোও হয়ে যায়। সৌম্যই বলে, "ঐ ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে এখানে না হয় ভাড়া দিয়েই থাকবেন। তাহলে তো তোমার আর আপত্তি হবে না।"
সংযুক্তার ভাঙা সংসারটা জাদুকাঠির ছোঁয়ায় বাঁচিয়ে দিয়েছিলো সৌম্য। সত্যিই বোধহয় ওর তুলনা হয়না, এমন জীবনসঙ্গী যদি সবাই পেত তাহলে হয়ত অনেক সমস্যাই মিটে যেত এভাবেই। কিট্টুটা ওপর নিচ দাপিয়ে বেড়ায় মনের খুশিতে যদিও একজন হেল্পিং হ্যান্ড রেখে দিয়েছে সংযুক্তা। খুশির মহলে সুখে আছে সংযুক্তা ওর ভরা সংসার নিয়ে। ভালো আছে সৌম্যও জোড়া মা বাবার আদরে। বললেই মুখ ব্যাকায় সংযুক্তা। একান্ত আদরে সংযুক্তাকে ভালোবাসায় ডুবিয়ে সৌম্য বলে, "আমার পাগলীটা, ভাগ্যিস এমন ভোলা মহেশ্বর বর পেয়েছিলে।" আজ আর কোন তর্ক করতে ইচ্ছে করেনা ওর, শুধু ডুবে যেতে ইচ্ছে করে আদরের গভীরে আর অনুভব করতে ইচ্ছে হয় প্রাণভরে উষ্ণতাকে।
........সমাপ্ত
"সোহাগ" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
©
Good story
ReplyDelete