সুজাতার প্রেমিক
![]() |
সুজাতার প্রেমিক - Green Vivacity |
রাত্রির বুক চিরে ধীরেধীরে ভোর হচ্ছে, পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। আরও একটা নির্ঘুম রাত শেষ করে আমি ধীর পায়ে বারান্দার আরামকেদারাটায় এসে বসলাম। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি অবশ্য উঠে আমার লেখার টেবিলে গিয়ে বসব। প্রতিদিন একটু একটু করে লেখার চেষ্টা করছি জানেন ! চোখের সামনে প্রতিনিয়ত এমন অদ্ভুত সব কান্ড ঘটতে দেখছি, যা লিখে না রাখলেই নয়। জানিনা জীবন্মৃত দশা থেকে কবে মুক্তি পাব ! আদৌ পাব কি না, তবে যদি পেয়ে যাই তাহলে তো নিজের কৃতকর্ম সমন্ধে একটা কৈফিয়ত দিয়ে যেতে হয় বৈকি ! আমি যে পাগল নই, আর পাঁচটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের সমান কি তাদের চাইতে খানিক বেশিই বুদ্ধি আমার মাথায় আছে তার প্রমাণ আমার এই লেখার খাতা। আমি অনেকক্ষণ লিখব.....লিখব.......তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ব, তারপর মাঝরাত্রে আমার ঘুম ভাঙবে সুজাতার ডাকে, সুজাতার নরম হাতের ছোঁয়ায় ! আমি জেগে উঠব ! একটু বুকটা ছ্যাঁতছ্যাঁত করে উঠবে তাও আমি প্রিয় সম্ভাষণ করব সুজাতাকে, তারপর সারারাত আমরা প্রেম করব ! তারপর ভোরের আলো ফোটার একটু আগে আমাকে সম্পূর্ণ রিক্ত করে দিয়ে সুজাতা চলে যাবে ! এই আমার নিয়তি ! নিয়তির হাত থেকে আর কে কবে রেহাই পেয়েছে বলুন ? দেখেছেন ! এই আমার এক রোগ হয়েছে, সব ভুলে যাওয়ার রোগ ! এতক্ষণ ধরে আপনাদের সাথে বকবক করছি অথচ এখনও আমার পরিচয়ই দিলাম না ! আমি সুজাতার প্রেমিক কথা বলছি ! কি বললেন ? এ আবার কেমন পরিচয় ? আজ্ঞে হ্যাঁ ! আমার এই একটাই পরিচয় ! একটাই নাম, আমি সুজাতার প্রেমিক ! এছাড়া আমার আর যেসব পরিচয় ছিল তা সব স্বেচ্ছায় একে একে ত্যাগ করে আজ প্রায় একযুগ ধরে এই প্রায় জনমানবরহিত এলাকায় এই বাড়িতে কাটাচ্ছি ! শুধুমাত্র সুজাতার প্রেমিক হয়ে।
আমার আর সুজাতার সেই ছোট্টবেলার প্রেম, কিশোরকালের শেষের দিকে আমাদের সবার জীবনেই এক উথালপাতাল সময় আসে, সেই বয়সে মানুষ নিজের বিচারবুদ্ধি অপেক্ষা আবেগের দ্বারা পরিচালিত হতেই বেশি ভালোবাসে। আমার আর সুজাতার প্রেমটা ঠিক ওই বয়সেই হয়েছিল। পাশাপাশি বয়েজ আর গার্লস স্কুল থাকলে এই বয়সে সাধারণত টুকটাক মুগ্ধতার আদানপ্রদান হয়েই থাকে, আমার বন্ধুরা প্রত্যেকেই এই ধরণের বয়সোচিত অভ্যাসে হাত পাকিয়েছিল, একমাত্র আমিই সাহস করে উঠতে পারতাম না, আমার বাবা শহরের নামকরা উকিল, সকলে এক ডাকে চেনে, কোনওরকমে যদি আমার চরিত্রবৈকল্যের কোনও খবর আমার বাবার কাছে যেত, তাহলে আমার আর রক্ষে ছিল না। তো যাই হোক, ক্লাস নাইনে থাকাকালীন বুবাই দার টিউশনে ভর্তি হলাম বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, সেখানে পড়াশোনা বাদ দিয়ে আর সব কিছুই হত। তবে কিনা পরীক্ষার আগে বুবাই দার করা সাজেশন দিয়ে পাশ নাম্বার তোলা কঠিন ছিল না ! তার ওপর বুবাই দার মধ্যে বেশ একটা "মাই ডিয়ার" ভাব ছিল, মাঝে মধ্যেই ছাত্রদের চপ, চকলেট খাওয়াতেন ! তাই আমাদের সময় ছাত্রদের মধ্যে বুবাই দার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া ! তো যাই হোক এই বুবাই দার কোচিংয়েই এক বৃষ্টিস্নাত বিকেলে আমার আর সুজাতার প্রথম দেখা হয়েছিল।ব্যাচ তখনও শুরু হয়নি আমরা জনা কয়েক ছেলে বসে বসে গুলতানি করছি, বাইরে অঝোরধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, এরমধ্যেই দেখলাম গোলাপি রংয়ের চুড়িদার পরে একটা বছর পনেরো-ষোলোর মেয়ে হাতের ছাতাটা বন্ধ করে এসে দাঁড়াল বুবাই দার বাড়ির বারান্দায়, ফর্সা ধবধবে গায়ের রঙ, ভাসাভাসা দুটো চোখ। মাথায় একটা বিনুনি বাঁধা। চুলের গোছ বেশী নয় কিন্তু বেশ লম্বা। বন্ধুদের কাছে শুনেছিলাম ওর নাম সুজাতা।আমাদের বয়েজ স্কুলের পাশের গার্লস স্কুলে এই বছরই আমাদের ক্লাসেই ভর্তি হয়েছে।
সেদিনের পর থেকে বুবাই দার ব্যাচে পড়তে যাবার সময়টুকু আমার জীবনের সবচেয়ে রঙিন হয়ে উঠেছিল। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমি ক্যাবলার মতন তাকিয়ে থাকতাম সুজাতার দিকে, কিছুদিন বাদে ব্যাচের বন্ধুরাও আমার এই ভাবের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিল আর এর জন্য যথেষ্ট টিটকিরি ও খেয়েছি।সুজাতা সব জেনে বুঝেও জেন নির্বিকার ! অনেকটা গর্বিণী মরালীর মত ভাব ছিল তার ! সে নিজের মত পড়তে আসত ব্যাচে মেয়েদের সাথে যতটুকু দরকার ততটুকুই কথা বলত, আমার দিকে কখনোই চেয়েও দেখত না। আমিও ক্যাবলার মত চেয়েই থাকতাম আর নির্বিচারে বন্ধুদের অত্যাচার সহ্য করতাম। একদিন পড়ার শেষে বুবাই দা আমায় ডাকলেন, আমার বুক দুরুদুরু করতে লাগল ! বুবাই দা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, "প্রথম প্রেম আমাদের মানুষ হিসেবে সমৃদ্ধ করে, কিন্তু সবাইকে কাঁদিয়েও ছাড়ে রে ছেলে ! পারবি তো সহ্য করতে ?" আমি কিছু না বলে ভ্যাবলার মত চেয়েছিলাম শুধু, বুবাই দা আমার পিঠ আলতো করে চাপড়ে দিয়েছিলেন। ফেরার পথে দেখলাম সুজাতা তখনও দাঁড়িয়ে ! আমি অবাক হয়ে চাইলাম ওর দিকে, হয়ত আমার চোখের ভুল কিন্তু যেন মনে হল সুজাতাও একবার আমার মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখল।
এভাবেই হয়ত কেটে যেত দিন, হয়ত কোনওদিনও সুজাতাকে আমার মনের কথা বলার সাহসও হত না আর আজকের দিনটাও আমার জীবনে আসত না ! কিন্তু ওই যে, কপালের লিখন ! তাই সেদিন বাড়ি ফিরেই আমার ধুম জ্বর এল। ডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন, "ম্যালেরিয়া ! একমাস টানা বেডরেষ্ট !" অতএব বাবার নির্দেশে আমি বিছানা নিলাম। কড়া আইনের সাথে চলল অখাদ্য পথ্য ! আমি নেহাতই মনমরা হয়ে পড়লাম। হু হু করে জ্বর আসতে লাগল।এভাবে বেশ কিছুদিন কাটল, তারপর একদিন বিকেলে বিছানায় বসে বেদানা খাচ্ছি আমাদের কাজের লোক সুখদাস দাদা এসে বলল, "এই দেখো ছোড়দাবাবু কে এসেছে ?" আমি উঠে বসে যাকে দেখলাম সে হয়ত শেষ মানুষ যে এখানে আসতে পারে বলে আমি কল্পনা করতে সাহস করতাম, "সু.. সু... সুজাতা !" আমি তুতলে বলে উঠেছিলাম। সুজাতা গম্ভীর মুখে বলেছিল "প্রায় দিন পনেরো পড়তে যাস নি, তাই বুবাই দা তোকে এই নোটস গুলো দিয়ে যেতে বললেন !" সুখদাস মিচকে মিচকে হাসি হাসছিল আমার কান্ড দেখে। আমি চোখ কটমট করতেই পালিয়ে গেল আমি সুজাতার দিকে মুখ ফিরিয়ে কিছু বলার আগেই সুজাতা বলেছিল, "কি রে বীরপুরুষ ! ক্যাবলার মত শুধু চেয়েই থাকবি ?" আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকলাম কিছুক্ষন তারপর বলেছিলাম, "তু..তুই আমার বাড়িতে এলি তোর ভয় করল না ?" সুজাতা রিনরিনে গলায় বলেছিল, "আমি তোর মত ভীতুর ডিম না বুঝলি ক্যাবলা ! নে এবার তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যা......." বলেই ছুট্টে বেড়িয়ে গেছিল সুজাতা। তারপর স্বাভাবিক কারনেই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছিলাম আমি। সেদিনের পর সুজাতা প্রায়ই আসত আমার মা খুব স্নেহ করতেন ওকে। গঙ্গা দিয়ে জল বয়ে গেল কত ! আমি আর সুজাতা ক্লাস টুয়েলভ পাশ করে কলেজে ঢুকলাম। ততদিনে আমার আর সুজাতার সম্পর্কের কথা আমাদের ছোট্ট শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সুজাতার মা বাবাও আমার সাথেই ওনাদের একমাত্র আদরের মেধাবী মেয়ের ভবিষ্যৎ দেখতে শুরু করে দিয়েছিলেন। অবাধ যাতায়াত ছিল ওর বাড়িতে আমার। তবে আমার বাবা ছিলেন এই সম্পর্কের ঘোর বিরোধী। নামজাদা উকিলের একমাত্র ছেলে কিনা শেষমেশ এক সামান্য মুদির মেয়ের সাথে প্রেম করবে ! এটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। এতদিন অনেকের কাছে কানাঘুষো শুনলেও মায়ের কথায় তিনি এই বিষয়ে বেশী মাথা গলাননি। কিন্তু ইদানীং ক্রমাগত শুনতে শুনতে তার বিরক্তির সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। একদিন সন্ধ্যাবেলায় সুজাতাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ঢুকেছি বাবা আমায় ডেকে পাঠিয়ে যা বললেন তার মর্মার্থ এই যে, "বাবা কোলকাতার একটি নামী 'ল' কলেজে আমাকে পড়তে পাঠাচ্ছেন, আর ওনার এক উকিল বন্ধুর মেয়ের সাথে আমার বিয়েও ঠিক করে এসেছেন সামনের অঘ্রাণেই আমায় ওনার বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করতে হবে"। আমি মাথা নীচু করে চলে এসে মায়ের কাছে কেঁদে পড়েছিলাম কিন্তু এবারে হাজার বোঝানোতেও কিছু হল না। বাবা বেঁকেই বসলেন, আমারও সাহস হল না বাবাকে কিছু বলি। মনেমনে গুমরে মরতে লাগলাম। একদিন সন্ধ্যাবেলায় বাড়িতে বসে আছি, সুখদাস এসে একখান চিরকুট দিয়ে গেল, সুজাতা লিখেছে "তোদের বাড়ির পেছনের বাগানে এক্ষুনি আয়।" ছুট্টে গেলাম। সেখানে দেখি সুজাতা দাঁড়িয়ে আছে, গালে-গলায় কালশিটের দাগ। চোখ দুটো কেঁদে কেঁদে ফুলিয়েছে। আমি কিছু বলার আগেই ও বলল, "আমাকে বিয়ে করতে পারবি তুই এক্ষুনি ?" আমি হকচকিয়ে উঠে বললাম "ক..ক্বেন রে হঠাত কি হল !" ও আমার ডান হাতটা ওর তলপেটে চেপে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। কি হয়েছে তা বুঝতে আমার বাকি থাকলনা আর উত্তেজনায় দরদর করে ঘামতে শুরু করলাম আমি।
বাবার কথা কিছুই বলতে পারলাম না ওকে, ও বলল- "শোন আমি বাড়িতে ধরা পড়ে গেছি ! এই মাসে ডেট মিস হয়ে গেছিল, মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল...তখনই..এই প্রথম বাবা আমার গায়ে হাত তুলল জানিস ! মা খুব কাঁদছে, যাক গে বাবা কাল সকালে তোদের বাড়ি যাবে, লক্ষীটি বাকি টা তুই সামলে নিস ! একটু অশান্তি হবে কিন্তু......।" অনেক কথা বলেছিল সেদিন সুজাতা। আমি ওকে প্রাণপণ জরিয়ে ধরেছিলাম, প্রেমে না তীব্র ভয়ে ! পরের দিন সকালে যা হবার তাই হল, বাবা সুজাতার বাবাকে চুড়ান্ত অপমান করলেন মায়ের হাজার কান্নাকাটিতেও তার মন গলল না। শেষে একদলা টাকা সুজাতার বাবার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, "মেয়েকে বলবেন এটা দিয়ে যেন পেটের পাপটাকে বিদেয় করে আসে আর কোনও দিনও যেন আমার ছেলের ধারকাছে না আসতে দেখি.... ইত্যাদি।" সুজাতার বাবা এক তীব্র করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার চেয়েই চলে গেলেন ধীরপায়ে। বাবা আদেশ দিলেন কোলকাতা যাবার আগ অব্ধি আমায় যেন ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। তাই হল। প্রায় দিন সাতেক একটা ঘরে আটকে রইলাম আমি নিজেই, বাইরে বেড়িয়ে সুজাতা কে আমার মুখ দেখাব কি করে ? এমন কঠিন দিনে যার পাশেই দাঁড়াতে পারলাম না তাকে কি মুখ দেখাব ! আটদিনের দিন সুজাতা নিজেই এল। আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানে আবার দেখা হল আমাদের। এই কদিনেই অনেক রোগা হয়ে গেছে সুজাতা চোখের কোনে কালি পড়েছে, মাথায় পাতলা একটা লম্বা বিনুনি। আমি চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না ওর দিকে, একসময় ও নিজেই ক্লিষ্ট স্বরে বলল, "খুন করে আসলাম রে ! পেটেরটা কে এক্কেবারে নর্দমায় ছুঁড়ে দিয়ে আসলাম ! আর ও জ্বালাতন করবে না আমাদের....." বলেই কেঁদে উঠল হাউমাউ করে।আমার অন্তরেও তখন এক তীব্র আবেগের সৃষ্টি হয়েছিল কান্না ভেজা গলায় বলেছিলাম, "ওরা আমাদের একসাথে বাঁচতে দেবে নারে ! তার চেয়ে চল একসাথে মরেই যাই !" সুজাতা দৃঢ় ভাবে আমায় জড়িয়ে ধরেছিল শুধু। তারপর আমরা ঠিক করেছিলাম সেদিন বিকেলেই দুজনে এক সাথে আত্মহত্যা করব।সুজাতা বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিল, তাই সায়ানাইডের জোগারটা ওই করেছিল। আমিও বাড়িতে একটা চিঠি লিখে রেখে পালিয়ে এসেছিলাম, প্ল্যান মাফিক রেললাইনের ধারে জনশুন্য এলাকায় দেখা হয়েছিল আমাদের। কি ভাবছেন ? আমি মরে গেছিলাম সেদিন ? আজ্ঞে না না অত সাহস আমার ছিল না ..... সুজাতাকে সায়ানাইড খেয়ে মরতে দেখে ভয়ে নিজের মুখে বিষ তুলতে পারিনি। কাপুরুষের মত পালিয়ে এসেছিলাম। ঘরের দোর বন্ধ করে সারারাত কেঁদেছিলাম। পরের দিন সবাই সব জানল। ভোরবেলায় রেললাইনের ধার থেকে কয়েকজন সাফাইকর্মী সুজাতার মুখে গ্যাজলা ওঠা মৃতদেহ উদ্ধার করেছিল। সুজাতার বুকের মধ্যে লুকানো সুইসাইড নোট থেকে সবাই সব ঘটনা জেনে গিয়েছিল।
সুজাতার বাবা মা পাড়ার লোকজনদের নিয়ে এসে শাপশাপান্ত করে গেলেন আমায়। পুলিশ কেস হত কিন্তু বাবার টাকার জোরে কেস ধামাচাপা পড়ে গেল। পরে শুনেছিলাম সুজাতার মা বাবা কাউকে কিছু না বলে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। একটা ঘোরের মধ্যেই আমি কোলকাতায় বাবার বন্ধুর বাড়িতে আসলাম।কলেজে ভর্তি হলেও পড়াশুনো হল না আমার আর ! আমি যেখানেসেখানে সুজাতাকে দেখতে শুরু করলাম।সেই প্রথম দিনের মত গোলাপি চুড়িদার, লম্বা বিনুনি, ধবধবে ফর্সা রঙ শুধু চোখের নীচে গভীর কালি।সুজাতা কে দেখে প্রথম প্রথম আমি দরদর করে ঘামতাম। অজ্ঞান হয়ে যেতাম। অবস্থা বুঝে বাবা আমায় ফিরিয়ে আনলেন, অনেক ডাক্তার বদ্যি পুজা মানত করা হল। একটা লোকদেখানো ব্যাবসা খুলে দিলেন বাবা আমায়। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে আমার বিয়ে দেওয়া হবে। "বাড়িতে একটা লক্ষীমন্ত বউ আসলেই সব পাগলামি ঠিক হয়ে যাবে" বলেছিলেন বাবা। আমিও আপত্তি করলাম না কারণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আমি মরিয়া ছিলাম আর বাঘ একবার রক্তের স্বাদ পেলে বেশী দিন অভুক্ত থাকতে পারে না। তাই মনে মনে আমি যুক্তি সাজাচ্ছিলাম যাতে সুজাতার মৃত্যুর পেছনে নিজের সকল দায় এড়াতে পারি। কিছুদিন বাদে কমলীনি কে বিয়ে করে বাড়ি ফিরলাম। কমলীনি বাবার সেই উকিল বন্ধুরই মেয়ে। ভাতকাপড়, বউভাত পার করে এসেছিল ফুলশয্যার রাত। কমলীনি বাসন্তী রঙয়ের বেনারসি পরে ফুলে সাজানো খাটে বসেছিল আমার জন্য। আমি শরীরের মনের উত্তেজনা প্রশমন করে ওর কাছে এগিয়ে গিয়েছিলাম। কাছে গিয়ে কমলীনির অনামিকায় একটা হীরের আংটি পরিয়ে পাকা প্রতারকের মত ছদ্মপ্রেম সম্ভাষন করে বলেছিলাম, "এতদিনে আমি পূর্ণ হলাম কমলা ! আর কিছুদিন আগে কেন দেখা হলনা আমাদের !" কমলীনি রিনরিনে গলায় বলল, "কে বলেছে আমাদের আগে দেখা হয়নি ? আমাদের তো সেই যুগযুগান্তর ধরে সম্পর্ক !" আমি আবেগবিহ্বল হয়ে কমলীনি কে চুম্বন করতে উদ্যত হয়েছিলাম। কিন্তু একি ! এ কে ?এতো আমার সদ্যপরিণীতা কমলীনি নয় ! সেই ধবধবে ফর্সা রং, সেই লম্বা বিনুনি ভাসাভাসা চোখ ! এ... এ... তো সুজাতা ! সুজাতা ফিরে এসেছে ? সুজাতা আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ তারপর বলল, "তোর জন্যে আমি হাসতে হাসতে বিষ খেয়েছি ! তোকে এই জীবনে আর কারো হতে দিই কিভাবে বল ?" সেদিন মরতে ভয় হয়েছিল নারে তোর ? বেশ তুই বাঁচবি ! অনেক লম্বা জীবন কাটাবি তুই, কিন্তু শুধুমাত্র সুজাতার প্রেমিক হয়েই কাটাতে হবে তোকে ! আর অন্য কোনও পরিচয় থাকবে না তোর।" পরের দিন সকালে কমলীনির মৃতদেহ পাওয়া গেল। হার্টফেল। আমি অচৈতন্য ছিলাম তিনদিন। কমলীনির বাবা পুলিশ কেস করেছিলেন কিন্তু ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কোনও অস্বাভাবিকতা পাওয়া গেল না বলে আমি বেঁচে গেলাম। দিনের মধ্যে বেশীরভাগ সময়ই আমি সুজাতার উপস্থিতি টের পেতে শুরু করেছিলাম। আবার হাজার ডাক্তার বদ্যি, সাধু কাপালিক আসতে লাগলেন কিন্তু সুজাতা আমায় ছাড়ল না। সবাই জানল আমি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছি।সারাদিন সুজাতার সাথে কথা বলি, ঘর থেকে বের হইনা তেমন একটা। এ সবের মধ্যেই একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল। আমার মা কোন এক সিদ্ধপুরুষের কাছ থেকে আমার জন্য এক তাবিজ নিয়ে এসে পরাতে গেলেন, আমি বারবার বারণ করা সত্বেও মা শুনলেন না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম সুজাতা আমার খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। মা আমার হাতে যে মুহূর্তে তাবিজ টা বাঁধতে গেলেন সেই মুহুর্তেই এক প্রচন্ড ধাক্কায় ঘরের উল্টদিকে ছিটকে গেলেন। মাথাটা দেওয়ালে ঠুকে গিয়ে পড়লেন একবার শুধু "মাগো !" বললেন তারপরই সব শেষ। লোকে ভাবল পাগল ছেলের হাতেই শেষ মেশ উকিল গিন্নীর প্রাণটা গেল, আমি কেঁদে উঠে সুজাতা কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "কেন করলি এমন ! মা যে তোকে বড় ভালবাসত !" সুজাতা খাটে বসে পা দোলাতে দোলাতে নির্বিকার মুখে বলেছিল, "আমি যে তোকে বলেছিলাম তোকে শুধু আমার প্রেমিক হয়েই বাঁচতে হবে ! আর কেউ আমাদের মাঝে এলে আমি তাকে...." বলেই প্রবল স্বরে হাসতে লাগল। তারমানে কমলিনীও...! আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরলে সুখদাসের কাছে শুনলাম মায়ের দাহকার্য শেষ হয়েছে, আমি এতটাই হতভাগ্য সন্তান যে একমাত্র সন্তান হয়েও মায়ের মুখাগ্নিটুকুও করতে পারলাম না। সেদিন গভীর রাতে খবর পেলাম আমার দশ বছরের পিসতুতো বোনটার ভারী অসুখ করেছে। বিছানায় শুয়েশুয়ে আমার খুব ভয় করতে লাগল। বাড়িতে আমার বৃদ্ধ বাবা, আমার বিধবা পিসি, দুই পিসতুতো ভাইবোন ! এদের সবাইকেই তাহলে ধীরেধীরে সুজাতা হত্যা করবে ! না না তার চেয়ে এই ভালো আমি আজ থেকে পুরপুরি ভাবে সুজাতার প্রেমিকই হয়ে উঠব ! ঠিক করলাম ঘর বাড়ি পরিবার পরিজন সব ছাড়ব ! চিৎকার করে সুজাতাকে বললাম, "সুজাতা ! আজ থেকে আমি শুধুই তোর প্রেমিক হয়ে বাঁচব, ঠিক যেমন তুই চাইছিলি !" বাড়ি ছেড়ে দেব তারপর আমি আর তুই অন্যকোথাও গিয়ে থাকব... তুই ওদের ছেড়ে দে ! লক্ষীটি মারিস না ওদের.." সুজাতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠ বলল "বেশ ! তাই হবে !" সেইরাতেই আমি সামান্য কিছু জিনিসপত্র আর টাকাকড়ি নিলাম। বাবাকে একটা চিরকুটে লিখলাম,"ঘর ছাড়লাম, আমায় খুঁজতে যেও না।"
তারপর নিজের মা আর সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর হত্যার দায় মাথায় নিয়ে বাড়ি ছাড়লাম। সুজাতাও এল আমার সাথেসাথে। তারপর কত পথ ঘুরলাম। কত গ্রাম শহর পার করে এই ভাঙাচোরা বাড়িটায় এসে উঠলাম। সেই এই থেকে চলছে। সারাদিন রাত আমি শুধু সুজাতার প্রেমিক হয়েই বেঁচে আছি। যতক্ষণ সুজাতা থাকে ততক্ষন ওর সাথে গল্প করি। কথা যেন আর শেষই হতে চায় না আমাদের। সুজাতা বসে বসে আকাশপাতাল ভাবে। জানিনা এই জীবন আমায় মুক্তি দেবে কবে ! হাতের আয়ুরেখার ওপর কতবার ব্লেড দিয়ে চিরে দেখেছি ! কিন্তু নাহ ! জীবন আমাকে মুক্তি দেয়নি ! তাও ভাবলাম যদি সত্যিই একদিন মুক্তি পাই তাহলে তো নিজের কৃতকর্মের জন্য একটা স্বীকারোক্তি রেখে যেতে হবে ! তাই এতকিছু বলে গেলাম আপনাদের।নাহ ! আজ আর ঘুমটা হবে না। ওই যে সুজাতা এসে গেছে ! শুনতে পাচ্ছেন আপনারা ওর পায়ের শব্দ ?এখন বাকি রাত্রি ধরে প্রেম করব ! আয় প্রিয়তমা ! আমি তোমার চিরকালের প্রেমিক... এস এসে বস আমার পাশে ! একটা গান গাই সুজাতা ! শুনবি ? "আমার সকল নিয়ে বসে আছি...সর্বনাশের আশায়...হা হা হা।"
........সমাপ্ত
"সুজাতার প্রেমিক" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
©
No comments