আতঙ্ক
![]() |
আতঙ্ক - Green Vivacity |
অফিস থেকে বেরিয়ে একটু এগোতেই আবার বৃষ্টি শুরু হল।আজ সারাদিনই আকাশ মেঘলা। সেই সঙ্গে চারিদিকে অন্ধকারও নেমেছে পাল্লা দিয়ে। বিকেলের অস্তিত্বটাকে মুছে দিয়ে সন্ধ্যে নেমেছে অসময়ে।বাসস্টপ অবধিও পৌঁছোতে পারল না সুমনা। একটা দোকানের শেডের তলায় দাঁড়িয়ে ব্যাগের মধ্যে রাখা ছাতাটা খুঁজতে লাগল। নাহ ! পেলনা। অগত্যা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
লোডশেডিং ! শহুরে এলাকায় লোডশেডিং আজকাল প্রায় হয়না বললেই চলে। কিন্তু আজ গোটা পাড়াটা যেন অন্ধকারে ডুবে আছে। তারমধ্যে বৃষ্টি হয়েছে আজ সারাদিন। বেশ ঠাণ্ডা আর গা ছমছমে ভাব যেন গোটা এলাকার স্বাভাবিক ছন্দটাকেই ডেকে ফেলেছে। অন্ধকার পাড়াটা যেন ফাঁদ পেতে রেখেছে সুমনারই অপেক্ষায়। আর একটু এগোলেই ওকে গিলে নেবে শিকারির মতো।
মোবাইলে টর্চের আলোয় সুমনা বাড়ির সামনে এসে পড়ল। (আজকাল মোবাইলে একই সঙ্গে অনেক সুবিধে থাকায় আলাদা করে টর্চ বা ঘড়ি অনেকেই ব্যবহার করেনা) । বাড়ি বলতে অবশ্য ভাড়ার বাড়ি। মফস্বলের মেয়ে সুমনা নতুন চাকরীতে জয়েন শহরে ভাড়াবাড়িতে উঠে এসেছে। বাড়ি-অফিস,অফিস-বাড়ি রোজকার এই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা আর সম্ভব হয়ে উঠচ্ছিল না তাই ভাড়াবাড়িতে উঠে আসা। তাও প্রায় একমাস হয়ে গেল। মা,বাবা প্রথম কদিন এসেছিলেন। সব গুছিয়ে দিয়ে আবার ফিরে গেছেন।
ঘরে ঢুকেই একরাশ কালো অন্ধকার ভেদ করে সুমনার মোবাইলের আলো অন্ধকারকে আরো রহস্যময় করে তুলল। সারাদিন অফিসের ধকল আর এখন এইরকম অন্ধকার। বাড়ি ফিরে চা খেতে খেতে টিভি দেখাটা ওর অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু আজ আর হবেনা। একটু বিরক্তই হল সুমনা। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। ফ্রেশ হয়ে মাকে ফোন করবে বলে ব্যাগটা বিছানায় ফেলে বাথরুমে ঢুকল।
ব্যাগে রাখা জিনিসগুলো বের করতে করতে হঠাৎ হাতে কিছু একটা ঠেকল। ছাতাটা ব্যাগে ? কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব ? তখনও তো ব্যাগে ছাতাটা খুঁজে পায়নি ও। আর কিছু ভাবতে পারছেনা সুমনা। মাথা যন্ত্রণা করছে ভীষণ। এই বাড়িতে আসা থেকেই এরকম ঘটনা ঘটেই চলেছে ওর সাথে। নাহ ! একটু চা করে খেতেই হবে।
চায়ের জল বসিয়ে মাকে ফোন করল সুমনা। কথা বলতে বলতে হঠাৎ কেমন অস্বস্তি শুরু হল। যেন কারোর থাকার অনুভূতি,যার থাকাটা অবাঞ্ছনীয়। কিন্তু পিছনে ফিরে তাকানোর সাহসটুকুও নেই ওর। যদি এমন কিছু চোখে পড়ে যার উত্তর জানা নেই,হয়তো সেই উত্তর পাওয়া সম্ভবও নয়।
মায়ের সাথে কথা শেষ করে চা নিয়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল সুমনা। এই পুরো বাড়িতে ওর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা এই জানলার সামনেটাই। একনাগাড়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। অন্ধকারময় এই রাতটাকে ভীষণ ভালোবাসতে ইচ্ছে করল সুমনার। পুরনো কথা মনে পরছিল আজ। বাবা মায়ের সাথে ওদের নিজেদের বাড়িতে থাকার কথা,তারপর চাকরীর কারনে এই বাড়িতে উঠে আসা। বাবা মা ছিলেন যতদিন সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। ওনারা বাড়ি ফিরে গেলেন আর তারপর থেকেই একাই এই বাড়িতে। অথচ একা যে সেটাই বা বলবে কি করে। বাবা মা চলে যাবার কিছুদিন পর থেকেই অন্যকারু উপস্থিতি টের পাচ্ছে সুমনা। যেন একি সঙ্গে কেউ বা কারা আছে আবার নেইও। কি ভীষণ অস্বস্তিকর মুহূর্ত সেটা সে কাউকে বোঝাতে পারেনা,হয়তো চায়ও না। সে জানে সবাই কি ভাবতে পারে। হয়তো সবাই ওকে বোঝাবে একা থাকার জন্য ওর মন নিজেই এসব কল্পনা করে নিয়েছে। মাকেও জানায়নি এসব কথা। অযথা চিন্তা করবে ভেবেই। আর ও নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি কেন হয় এরকম। হয়তো রান্না করছে,হঠাৎ মনে হল কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। ঘাড়ের কাছে কারোর দীর্ঘশ্বাস...যেন কত গভীর কষ্ট থেকে উঠে আসা সেই নিশ্বাস। আবার কখনও হাতের কাছেই রাখা কোনো জিনিস,সে নিজেই রেখেছে অথচ সেখানে খুঁজে পায়নি। আবার কিছুক্ষণ পরে দেখেছে সেই হারিয়ে ফেলা জিনিস যথাস্থানেই রাখা।
কিন্তু একী ! ও ছাদে কখন চলে এসেছে ? অন্ধকারটা ওকে ভীষণ টানছে। কি সুন্দর এই ঘন কালো রাত। যেন সমস্ত অসুন্দরকে নিজের মধ্যে আশ্রয় দিয়েছে। ঝাঁপিয়ে পড়বে অন্ধকারটায় ? ওকে ও কি আশ্রয় দেবে এই মায়াবী রাত ? কে যেন ওকে বলে উঠল...ঝাঁপিয়ে পড়। এখানেই শান্তি।
এ কিসব ভাবছে সুমনা। কোন দৈববলে সম্বিত ফিরে পেয়েছে সে। তড়িঘড়ি নেমে আসে ছাদ থেকে। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে মুখে জল দেয়। নানান কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরে সুমনা।
গলার কাছটা ভারী হয়ে আসছে। উফফ! কি ভীষণ কষ্ট। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় সুমনার। কেউ যেন ওর স্বাভাবিক নিশ্বাস নেওয়ার পথটাকে বন্ধ করে দিতে চাইছে। জোর করে উঠে বসে সে। আতঙ্কে শিউরে উঠে বারবার। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। রান্নাঘরে জল খেতে যায় সুমনা।
ওটা কি চকচক করছে ? এতো সুন্দর ! অন্ধকারটাকে খুন করে নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে চাইছে ধারালো ছুরিটা। পরম স্নেহে ছুরিটাকে হাতে তুলে নেয় সুমনা। আফসোস হয়...এতদিন এই সুন্দর জিনিসটা পরে পরে নষ্ট হচ্ছিল ? আচ্ছা এটা যদি কারো শরীরে বিঁধিয়ে দেয় ? প্রথমে নিজের শরীরেই আঘাত করে সুমনা। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে ছুরিটা ফেলে দেয় সে।নাহ ! আর এক মুহূর্ত এই বাড়িতে নয়। এই বাড়ি মৃত্যুদূত ছাড়া আর কিছু নয়।
ধাক্কাটা সামলে উঠতে অনেকটাই সময় লেগেছিল সুমনার। একা থাকতে পারতোনা,রাতে ঘুমতে পারতোনা। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠত। ডাঃ ঘোষ বলেছিলেন সুমনা কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যেকার সুক্ষ্ম প্রাচীরটা ভেঙে দুই জগতকে মিলিয়ে ফেলেছিল। যারফলে ও নিজেই নিজেকে আঘাত করে। নিজেই কোনো জিনিস সরিয়ে ফেলে যাতে নিজেই খুঁজে না পায়। পরে সেটা আবার যথাস্থানে রেখে দিয়েছে। কিন্তু এই সমস্ত কিছু ওর মনে থাকেনা। তাই ও এইসবের ব্যাখ্যা অতিপ্রাকৃত ঘটনা হিসেবে মেনে নেয়।
আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেছে সুমনা। ডাঃ ঘোষের ব্যাখ্যা সবাই মেনে নিয়েছে আর সুমনাও। অফিসে যাতায়াতও শুরু করেছে নিয়মমতো। আজ অফিস থেকে বেরোতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। তবু ফেরার পথে কেমন যেন হঠাৎ আবার ওই বাড়িটার জন্যে টান অনুভব করল সুমনা। ট্যাক্সি ওকে নিয়ে সোজা ওই বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল।
দোতলা বাড়িটাতে এখনো নতুন ভাড়াটে আসেনি। শূন্য বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। সুমনা তার সেই প্রিয় জানলাটার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। বড্ড মায়ায় জড়ানো বাড়িটা। হঠাৎ মনে হল ও একাই তাকিয়ে নেই বাড়িটার দিকে। জানলার আড়াল থেকে কেউ কি দেখছে ওকে ?চোখাচোখি হতেই সরে গেল সে। কিন্তু কে ?কে ও ?প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে জট পাকিয়েছে। বাড়িটা যেন ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে নিজের দিকে। সুমনা এগিয়ে যায় বাড়িটার দিকে।
পরের দিন সকালে অল্প বয়সী একজনের মৃতদেহ পরে থাকতে দেখা যায় রাস্তায়। সুমনা মারা গেছে। আতঙ্কে ওর হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছিল। কিন্তু কেন এতো অল্প বয়সী একটি মেয়ের মৃত্যু হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে হয় ? কেউ কি এর উত্তর কোনদিন খুঁজে পাবে ? নাকি রহস্যের আড়ালেই থেকে যাবে সুমনার মৃত্যু কিংবা ওই ভাড়াবাড়ির রহস্য ?
● "আতঙ্ক" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না । আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
No comments