রুহির অসম্পূর্ণ হিমু

রুহির অসম্পূর্ণ হিমু - Green Vivacity

               জানিস ! আমার অনেক দিনের শখ,হিমুর সাথে একবার দেখা করার। তবে হ্যাঁ, যে সে হিমুর সাথে নয়,হিমুকে পুরোপুরিভাবে আয়ত্ত করেছে যে তার সাথে। তাকে দেখলে বা কথা বললে যেন মনে হয়-আরে তবে কি সম্পূর্ণ  হিমু বাস্তবেও আছে ? যদিও বলা হয়ে থাকে যে সবার মধ্যে নাকি হিমুসত্ত্বা বিদ্যমান। কিন্তু ক'জনই বা পারে নিজের বৈশিষ্ট্যকে ত্যাগ করে সম্পূর্ণভাবে হিমু হয়ে উঠতে ? আর এ একটা গান আছে না হিমুকে নিয়ে-এই শহর এখনো হিমু হতে চায় !!!! শুনিস নি ?

এই হিমুটা কে ? আর হিমু বাস্তবেও আছে,এর মানেই বা কি ? ও কি কাল্পনিক নাকি ?

রুহি হা করে তাকিয়ে থাকে অনয়ের দিকে। রুহির মুখ দেখে মনে হচ্ছে, এই তেইশ বছরের জীবনে সে এরকম হতবাক করার মতো কথা আর কখনো শোনে নি।

কি বলছিস কি এসব ? তোর মাথা ঠিক আছে তো ? চল তোকে আমি একজন ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। অনয় তো বুঝতেই পারছে না,সে কি এমন কথা বলল যার জন্য রুহি হতভম্ব হয়ে গেল।

কিরে চল !
কোথায় ?
ডাক্তারের কাছে !
কেন ?
তুই কি জানিস তুই কি বলেছিস ?
যাঃ বাবা, আমি আবার কি বললাম ?
তুই হিমু পড়িস নি ? হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম পড়িস নি ?
সে আবার কি জিনিস ?

রুহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,থাক বাদ দে। যখন হিমুকেই চিনিস না তখন আমার শখের কথা শুনেও লাভ নেই।
ঠিক আছে।শুনবো না।কিন্তু হিমুর সাথে কেন দেখা করতে চাস তুই ? সে কি দেখতে খুব ভালো ? কি করে সে ?

হিমুকে জানতে চাস ? তবে শোন- হিমু হলো মানুষকে বদলে দেওয়ার অদম্য শক্তি, হিমু হলো মানুষের ভালো থাকা এবং মানুষকে ভালো রাখার এক অনন্য উপায়, হিমু হলো হাজারো মানুষের ভালোবাসা দিয়ে গড়া এক কাল্পনিক চরিত্র আর হাজারো মানুষকে হিমু বানানোর কারিগর, যার সৃষ্টিকর্তা আমার প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ । হিমু জানে কষ্টকে কি করে উপেক্ষা করে বাঁচতে হয়। হিমু হলো সে, যে পুলিশ কিংবা র‍্যাবের কাছেও নির্ভয়ে  যেতে পারে। হিমু কখনো কোনো মায়ায় জড়িয়ে পড়ে না। হিমু হলো সেই চরিত্র যে দিনে খালি পায়ে উত্তপ্ত রাস্তায় হাঁটতে আর রাতে নিস্তব্ধ পরিবেশে একা রাস্তায় চলতে ভালোবাসে,আসলে ভালোবাসে বললে ভুল হবে,সে এমনই জীবনযাপন করে। তার জীবনের সঙ্গী বলতে আছে একমাত্র, তার বাবার উপদেশ। আর প্রত্যেক পূর্নিমার রাতে আকাশের জ্যোৎস্না উপভোগ করে সে। এছাড়া আরও অনেক বৈশিষ্ট্য আছে ওর। হিমুকে জানতে হলে ওর গল্প পড়তে হবে।

মানুষ আবার এর মতোও হতে চায় নাকি ?
একথা বলেই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে অনয়।

একবার হিমু পড়েই দেখ না,তারপর না হয় বলবি যে, তুই হিমু হতে চাস না।

আমার আর হিমু হয়ে কাজ নেই। কি হবে হিমু হয়ে ?সারাদিন রাত কি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো ? তাহলে খাবো কি আর পরিবারকে খাওয়াবোই বা কি ?

তোকে হিমু হতে হবে না। তুই তো হাঁদারাম।
হ্যাঁ তাও ভালো।
চল না কিছু খাই। ক্ষিধে পেয়েছে আমার।
চল। খেয়ে আবার বাড়ি যেতে হবে।
তারা খেয়ে দেয়ে বাড়ি চলে যায়। আবার এক সপ্তাহ পর তাদের দেখা হবে।

রুহি আর অনয় খুব ভালো বন্ধু। ওদের বন্ধুত্ব দেখে মনেই হয় না যে ওরা ফেসবুক ফ্রেন্ড। আজ তিন বছর ধরে ওদের বন্ধুত্ব। দুজনই দুজনকে ভালোবাসে। কিন্তু কেউই কাউকে বলতে পারে না।

অনয় বর্তমানে একটা ভালো কোম্পানীতে চাকরি করে।আর রুহি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। সপ্তাহে বড়জোর তাদের একদিন দেখা হয়। অনয় হলো শান্তশিষ্ট আর রুহি তার উল্টো। তাকে সারাদিন ধরে কথা বলার চাকরি করতে দিলে খুব ভালো পয়সা উপার্জন করতে পারবে। তবে রুহি হলো সাহিত্যপ্রেমী, যদিও সে সাইন্সের স্টুডেন্ট।

তাদের মধ্যে ঝগড়া হয় তবে খুব বেশি না। প্রত্যেক মাসে দু'একবার করে ব্রেক আপ হয়,এই আর কি ! তবে ঝগড়া কিংবা ব্রেক আপ কোনোদিনই একঘন্টার বেশি স্থায়ী হয় না। একঘন্টার মধ্যেই দুজনের মধ্যে মিটমাট হয়ে যায়। এভাবেই চলছিল তাদের দিন। দুজন দুজনকে নানা কথার মাধ্যমে বলতে চায় ভালোবাসার কথা। কিন্তু কেউই মুখ ফুটে সরাসরি ভালোবাসি বলে না। একদিন তো রুহি বলেই বসেছিল, - তুই যাকে বিয়ে করবি সে খুব লাকি হবে। কিন্তু তারপরও কথায় কথায় ভালোবাসার কথা বলতে পারে নি।

ওরা ভালোবাসার কথা বলুক বা নাই বলুক, সময় তো আর ওদের জন্য থেমে থাকবে না। রুহির বিয়ের বয়স হয়েছে। তার মা বাবাও ছেলে দেখা শুরু করে দিয়েছেন। এইদিকে রুহি বাড়িতে না অনয়কে বিয়ে করার কথা বলতে পারছে না অন্য কাউকে বিয়ে না করার কথা বলতে পারছে। বাবা ভীষণ রাগী। বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে যে কিভাবে অনয়ের সাথে দেখা করতে যায় তা একমাত্র সেই জানে।

কিছুদিন পর..........................

অনেক্ষণ হয়ে গেলো অনয় রুহির জন্য অপেক্ষা করছে। সে খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। কারণ রুহি কখনো দেরী করে না। তবে আজ কি হলো ? ওর কোনো বিপদ হলো না তো ? এসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তার মুখে হাসি ফুটল। হ্যাঁ,ঠিকই ধরেছেন, রুহি এসেছে।

কিরে এতো দেরী হলো যে ?
এমনি। দেখছিলাম অপেক্ষা করিস কি না !
এ আবার কেমন কথা ? আমি কি তোর জন্য অপেক্ষা করি না ?
আর অপেক্ষা করতে হবে না.
কেন ? কি হয়েছে ? আর এভাবেই বা কেন কথা বলছিস ?
আমাকে দুদিন পর ছেলেপক্ষরা দেখতে আসবে।

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর,.............

ও এই ব্যাপার.......! ছেলে দেখতে আসবে আসুক,এতে মুখ গোমরা করার কি আছে ?

রুহি অনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রানপন চেষ্টা করছে,চোখের জল আটকানোর। কিন্তু অনয়ের যেনো কোনো হেলদোলই নেই ! তবে কি রুহির ধারণা ভুল ছিল ? অনয় কি রুহিকে ভালোবাসে না ?

আর অপেক্ষা না করার কি আছে ? তোর বিয়ের পর কি আমরা আর বন্ধু থাকব না ?শেষ হয়ে যাবে আমাদের বন্ধুত্ব ?

রুহি নিশ্চুপ। সেদিন রুহি অনয়ের সাথে কোনো কথাই বলে নি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, অনয় সারাদিন ধরে বকবক করে গেছে। সন্ধ্যা হতেই রুহি বাড়ি চলে আসে। অনয় রুহিকে অনেকবার কল করেছিল কিন্তু সে রিসিভ করে নি আর কল ব্যাকও করে নি। এই দুইদিন রুহি সারাক্ষণ অন্য মনষ্ক হয়ে ছিলো। কেউ কোনো কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তরও দিত না। সে যেন চিৎকার করে বলতে চাইত যে, সে অনয়কে ভালোবাসে,আর তাকেই বিয়ে করতে চায়। কিন্ত বলার সাহস তার নেই। অনয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ মুখ ফুলে গেছে।

দেখতে দেখতে দুদিন কেটে গেল।

আজ রুহিকে খুব সুন্দর লাগছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজ তাকে অনয়ের দেওয়া নীল শাড়িটা পড়তে হয়েছে।যদিও কেউ জানে না যে শাড়িটা অনয়ের দেওয়া। আজ রুহির চোখে কাজল,কপালে টিপ আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক,কানে দুল, পায়ে নূপুরও আছে। কি অপূর্ব লাগছে তাকে দেখতে !

এতে রুহির ভীষণ রাগ হয়। এতো সাজানোর কি আছে কে জানে ? এরকম অবস্থায় দেখলে তো যে কেউই তাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়ে যাবে।
রুহি সেজেগুজে তার রুমে বসে আছে। অনয়ের সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো শুধু মনে পড়ছে । খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তবে কি অনয়কে সে কোনোদিনই পাবে না ? তার সত্যিকারের ভালোবাসা কি তবে হেরে যাবে ? কিন্তু রুহিরও তো কিছুই করার নেই। এটাই হয়তো তার নিয়তি।

একসময় তাকে ছেলে পক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়।কারোর দিকেই তাকাচ্ছে না রুহি। কিন্তু আড়চোখে দেখতে পেল,ছেলেটা হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে। রুহি মনে মনে বলছিল, যত্তসব আদিক্ষেতা। দেখলে গা জ্বলে যায়।

এরপর ছেলেটির সাথে আলাদা করে কথা বলার জন্য তাদেরকে অর্থাৎ রুহি আর ছেলেটিকে ছাদে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রুহি তো মনে মনে ঠিক করেই নেয় যে, সে ছেলেটাকে তার বিষয়ে সব বলবে আর সে যেন এই বিয়েটা না করে তার জন্য অনুরোধ করবে। দরকার হলে ছেলেটার পায়ে পড়তেও রাজি আছে সে।
 কথাটা বলতে যাবে এমন সময় ছেলেটি বলে ওঠে, - কিরে ! একটিবারের জন্যও তাকিয়ে দেখবি না আমার দিকে ? আমি কিন্তু আমার সব নীলপদ্ম তোকে দেওয়ার জন্য রেডি।

রুহি হকচকিয়ে যায়। এ কার গলা শুনছে সে,আর কাকেই বা দেখছে ? এ কি বাস্তব না তার কল্পনা। কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না,শুধু তাকিয়ে আছে হলুদ পাঞ্জাবি পড়া অনয়ের দিকে।
অনয় হেসে ওঠে রুহির এই অবস্থা দেখে।

নিবি না আমার নীলপদ্ম ?

আনন্দে কেঁদেই ফেলে রুহি আর অনয়কে জড়িয়ে ধরে। জীবনে এই প্রথম বার সে জড়িয়ে ধরে অনয়কে।অনয় কোনোরকমে রুহির কান্না থামিয়ে বলে- পেরেছি কি তোর হিমু হতে ?

না,সেটা কোনোদিনই সম্ভব না। তুই কখনো সম্পূর্ণ হিমু হতে পারবি না।

কেন ? আমি হলুদ পাঞ্জাবি পড়েছি আর খালি পায়েও এসেছি। আর তুই কি জানিস ? এই দুদিন খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি।

তবুও তুই হিমু হতে পারবি না ?
কিন্তু কেন ?
কারণ হিমু কখনো তার নীলপদ্ম কাউকে দেয় না।
তাহলে ! এবার কি হবে ?
রুহি হেসে হেসে বলে, নাই বা হতে পারলি সম্পূর্ণ হিমু,তাতে ক্ষতি কি ? সারাজীবন না হয় আমাকে তোর সব নীলপদ্ম দিয়ে আর আমার সব নীলপদ্ম নিয়ে অসম্পূর্ণ হিমু হয়েই থাকবি আমার কাছে !

অনয়ও হেসে হেসে বলে- পারবো, তোর জন্য আমি সব পারবো।

এরমধ্যে হঠাৎই বৃষ্টি শুরু হয়। প্রকৃতিও যেন তাদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে আজ। দৌড়ে ঘরে না গিয়ে তারা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে ভিজতে থাকে বৃষ্টিতে।
আমিও তাদেরকে আর বিরক্ত না করে একা ছেড়ে দিয়েছি। থাকুক ওরা ওদের মতো।



● "রুহির অসম্পূর্ণ হিমু" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না । আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।


মেহেদী হাসান পিয়াস


No comments

Powered by Blogger.