হাওয়াবদল
![]() |
হাওয়াবদল - Green Vivacity |
অনেকক্ষণ থেকেই প্রতীকের মেজাজের পারদটা ঊর্ধ্বমুখী। তা হবে নাই বা কেন ! একে তো আই.টি সেক্টরের চাকরিতে ছুটি বলতে কোনো শব্দ নেই, তাও যদি অমাবস্যার চাঁদের মতো একটা জোটে, তখন নাকে তেল দিয়ে এগারোটার সময় ঘুম থেকে না উঠলে তো ছুটিরই অপমান করা হয়। কিন্তু কপালে সুখ নামক বস্তুটি না থাকলে কি আর করা যায় ! ভেবেছিল অন্যবারের মতো এযাত্রাও কিছু একটা বাহানা দিয়ে বিষয়টা এড়িয়ে যাবে, কিন্তু এবার মা ও আঁটঘাট বেঁধে যুদ্ধে নেমেছে আর বাবা তো সকাল থেকেই চুুপ। অগত্যা কোনো উপায় না দেখে মায়ের বাধ্যপুত্র বেজারমুখে বিকেলবেলা সপরিবারে পাত্রীদর্শনে বেরিয়ে পড়লেন।
স্যান্যাল ফ্যামিলি অতিথি আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যে পাত্রীর মা ও বড়বোন মেয়েকে নিয়ে এলেন। "আমার বড়মেয়ে উপালী আর এই হচ্ছে ঊষসী"। দিবাকরবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন। বাবা,মা আগে একবার এখানে ঘুরে গেলেও প্রতীক এই প্রথম এলো স্যান্যালবাড়িতে।
ঊষসী এগিয়ে এসে প্রতীকের বাবা মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেও উপালী ওখানে দাঁড়িয়েই হাতজোড় করে নমস্কার করল। দুই পরিবারের কথাবার্তার মাঝে মাঝেই প্রতীকের চোখ বারবার ঘরের এককোণে চুপ করে বসে থাকা উপালীর দিকে চলে যাচ্ছিল। অল্প লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় কেমন যেন এক বিষন্নতা ছেয়ে আছে মেয়েটার চোখদুটোতে।
"কিরে পাত্রী পছন্দ হলো ?" বাড়ি ফিরে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন প্রণবেশবাবু।
"বাবা, উপালীর বিয়ে না দিয়ে ওনারা আগে ঊষসীর বিয়ে কেন দিচ্ছেন ?"
"সেকিরে, সকালবেলা যে তোকে ওদের বিষয়ে সবকিছু বললাম, ভুলে গেলি এতো তাড়াতাড়ি !" অবাক হয়ে ছেলেকে বললেন নীলিমাদেবী।
"কি বলেছিলে ?" কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় প্রতীক।
"আজ থেকে দুবছর আগে একটা কন্সট্রাকশন সাইটের দূর্ঘটনায় স্পটডেড হয়ে যায় উপালীর হাজবেন্ডের।স্বামীহারা বৌকে শ্বশুরবাড়িতে বেশিদিন রাখতে চায়নি।তার কিছুদিন পর দিবাকরবাবু মেয়েকে বাড়ি নিয়ে আসেন। সেই থেকে উপালী ওদের সঙ্গেই আছে। ভীষন কোয়ালিফায়েড মেয়ে জানিস। একটা কলেজে বায়োলোজির প্রফেসর হওয়ার পাশাপাশি দারুণ গানও গায়। আমরা প্রথম যেদিন গেছিলাম ওদের বাড়ি, সেদিন অপূর্ব একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শুনিয়েছিল আমাদের। অথচ বেচারির ভাগ্যটাই খারাপ। কিন্তু তুই হঠাৎ উপালীর কথা জানতে চাইছিস কেন ?" ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন নীলিমাদেবী।
মায়ের কাছে কথাগুলো শুনতে শুনতে কেমন যেন অন্যমন্সক হয়ে পড়েছিল প্রতীক। শেষের প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলে,"নাহ্ এমনি।"
রাতে কিছুতেই ঘুমোতে পারছিল না প্রতীক। চোখ বন্ধ করলেই বারবার উপালীর উদাস চেহারাটা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। কেন জানি মনে হয়েছিল অনেক না বলা কথা, যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে ঐ চোখদুটোতে। যেন সকলের মাঝে থেকেও একাকিত্বে ঘিরে আছে মেয়েটা। মায়ের কাছে শুনেছিল ঊষসী থেকে তিনবছরে বড় উপালী। তারমানে মাত্র সাতাশ বছর বয়সেই মেয়েটির জীবনে এতবড় ঝড় বয়ে গেছে !
পরদিন রোববার থাকায় কিছুটা দেরিতেই ঘুম থেকে উঠল প্রতীক। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বলল,
"মা, বাবা, তোমাদের সঙ্গে কিছু কথা আছে। আমি যদি উপালীকে বিয়ে করতে চাই, তোমাদের কি কোনো আপত্তি আছে ?"
"যা বলছিস ভেবে বলছিস তো ?" একদৃষ্টে ছেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন প্রণবেশবাবু।
"হ্যাঁ।" বাবার চোখে চোখ রেখে দৃঢ়কন্ঠে উত্তর দিল প্রতীক।
"কিন্তু ওনারা কি এই প্রস্তাবে রাজি হবেন ?" চিন্তিতস্বরে স্বামীকে প্রশ্ন করলেন নীলিমাদেবী।
"কেন হবেন না ! ওনারাও নিশ্চয় চাইবেন ওনাদের মেয়ে সুখী হোক, আর আমার বিশ্বাস প্রতীক উপালীকে ভালো রাখবে।" স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বললেন প্রণবেশবাবু।
"তাহলে তোমাদের কোনো প্রবলেম নেই এই বিয়েতে ?" রাতে অনেক ভেবেচিন্তে এই ডিসিশন নিলেও বাবা, মা যে এত সহজে বিষয়টা মেনে নেবে ভাবতেই পারেনি প্রতীক।
"তুই যদি উপালীর সঙ্গে ভালো থাকিস তবে আমাদের কেন আপত্তি থাকবে ! তোর বাবা,মায়ের মানসিকতা এত সংকীর্ণ নয় যে শুধুমাত্র 'বিধবা' তকমাতে একটা ভালো মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করব। অবশ্য এই বিষয়ে হাল্কা আঁচ আমরা গতকালই পেয়েছিলাম যখন তুই বারবার উপালীর দিকে তাকাচ্ছিলিস।" ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন নীলিমাদেবী।
"তোমাদের কি মাথাখারাপ হয়ে গেছে ? ওনারা ঊষসীর বিয়ের কথা বলতে এসেছিলেন, আমার নয়।" রীতিমতো চিৎকার করে বলে উঠে উপালী।
"কিন্তু প্রতীক তোকে বিয়ে করতে চায়, ঊষসীকে নয়।" মৃদুলাদেবী মেয়েকে বললেন। "কে কি চায় তাতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। ঊষসী জেদ না করলে সেদিন আমি যেতামই না ওইঘরে।" কাঁদতে কাঁদতে বলল উপালী। "উপালী,ওই দূর্ঘটনার পর আমরা একবারও তোর আবার বিয়ের প্রসঙ্গ তুলিনি, কারণ আমাদের মনে হয়েছিল তোকে কিছুটা সময় দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আজ যখন সবকিছু জানার পরও প্রতীকের পরিবার তোকে সানন্দে গ্রহণ করতে রাজি, তখন অহেতুক জেদের বশে এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিসনা।" শান্তভাবে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন দিবাকরবাবু।
"এই সমাজ তা মেনে নেবে না বাবা। বিধবা বিবাহ আইনত গ্রহণযোগ্য হলেও বিধবা মেয়ের বিয়েতে সকলেই বাঁকাচোখে তাকায়।"অসহায়ভাবে বলল উপালী।
অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে এবার বলল ঊষসী,"তুই কাকে ভয় পাচ্ছিস দিদি ? তোর বরের মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যখন তোকে রাখতে অস্বীকার করেছিল, তখন এই সমাজ দাঁড়িয়েছিল তোর পাশে ? আজকাল রাস্তায় যখন কিছু নারীমাংসলোলুপ হায়ানারা তোর দিকে কুৎসিত দৃষ্টিতে তাকায়, তখন আগলে রাখে তোকে এই সমাজ ? সবাই শুধু দাঁড়িয়ে থেকে তোর অসহায়ত্বের তামাশাই দেখেছে। তাই বলছি মিথ্যে সমাজের ভয়ে অকারণে নিজেকে আর শাস্তি দিসনা। কে জানে হয়তো এবার তুই সত্যিই সুখী হবি।"
"কিরে, আর কতসময় লাগবে তোর ? ওদিকে যে আপনার হবু পতিদেবতাটির বুক আনচান করছে শুভদৃষ্টির জন্য।"
"ওফফ্ প্রতীকদা, আজকের দিনেও তুমি আমাকে শান্তিতে মেকআপ করতে দেবে না ?" তেড়ে উঠল ঊষসী। "আরে আমি কি করব বল ! পুরুতমশাই বললেন বিয়ের লগ্ন নাকি পেরিয়ে যাচ্ছে, তাই এলাম উপকার করতে। কলিকাল কি আর লোকে সাধে বলে !" মুখটা কালো করে বলল প্রতীক। "ইশশশ... কতবড় উপকার করলে গো তুমি আমার।" মুখ বেঁকিয়ে বলল ঊষসী।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে প্রতীক আর ঊষসীর খুনসুটি দেখছিল উপালী। সত্যি বলেছিল ঊষসী, সেদিন যদি সমাজের ভয়ে প্রতীককে ফিরিয়ে দিত উপালী তাহলে হয়তো আজ এভাবে বদলাতো না ওর জীবন। প্রতীক শুধু স্বামী হিসেবে নয়, দিবাকরবাবু ও মৃদুলাদেবীর ছেলের স্থানটাও যেন নিঃশব্দে পূরণ করে দিয়েছে। এরকম একটা জীবনই তো চেয়েছিল উপালী। হঠাৎ কানের পাশে মৃদু পুরুষালিকন্ঠে শুনতে পেল, "আজ তোমাকে দেখতে দারুন লাগছে।"
ঘাড় ঘোরাতেই দেখে প্রতীক ওরদিকে তাকিয়ে অল্প হেসে ঊষসীকে নিয়ে বিয়ের মন্ডপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই একবছরে দুজনে একবারও মুখে বলেনি 'ভালোবাসি'। তবু কোনো এক অচ্ছেদ্য বাঁধন যেন প্রতিদিন ওদের আরো শক্ত করে বেঁধে চলেছে। যে বাঁধনের কোনো পোষাকী নাম ওরা দিতে চায় না। জীবনে কিছু কিছু কথা অনুচ্চারিত থাকলে হয়তো তার মূল্য দিনদিন বাড়তে থাকে।
"হাওয়াবদল" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না । আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
No comments