প্রথম বান্ধবী

প্রথম বান্ধবী - Green Vivacity



           সেদিন দাদুর হাত ধরে প্রথম স্কুলে গেলাম ভর্তি হতে । তখন বয়স ছিল পাঁচ বছর। জীবনে প্রথম স্কুলের গন্ডিতে প্রবেশ করলাম। দাদু আমাকে স্কুলে রেখে বাড়ি চলে গেল। ভয় যে করছিল না, তা নয়। আসলে অনেক আগে থেকে এই স্কুলে আমার অবাধ আসা-যাওয়া ছিল পাড়ার দিদি-পিসিদের সাথে। সেই পরিচিতি ছাড়াও আমার পড়াশোনার দক্ষতায় অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন স্কুলের হেড মাস্টার।

এতদিন দিদি-পিসিদের সাথে বিভিন্ন ক্লাস রুমে গিয়ে বসেছি। কিন্তু আজ আমি আমার নিজের ক্লাসরুমে গিয়ে বসব। দাদু তো চলে গেল। কিন্তু এবার কোন রুমে বসব ! দেখলাম এক দিদি আমার দিকে হাসি মুখে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরল। আমাকে নিয়ে গেল একটা ক্লাসরুমে। তারপর আমাকে কোলে তুলে টেবিলে বসিয়ে দিল। দিদি বলল,"এটা শিশু শ্রেণীর ক্লাস রুম। তুই রোজ এই ঘরে বসবি।"

তুমি কোন ক্লাসে পড় ?

আমি ওয়ানে পড়ি। মনে হয় আমাকে তুই চিনিস।

একটু চেনা মনে হল দিদি কে, তাই মাথা নেড়ে বললাম,"হুম,চিনি। তোমার বাড়ি এই স্কুলের থেকে একটু দূরে।"

"ঠিক বলেছিস," বলেই দিদি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমি ভয়ে চেঁচিয়ে বললাম," আমাকে টেবিল থেকে নামিয়ে দিয়ে যাও !"

দিদি ফিরে এসে আমার গাল টিপে দিয়ে আমাকে টেবিল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল,"একদম ভয় পাবিনা "। দিদি তার ক্লাস রুমে চলে গেল ।

এরপর থেকে রোজ স্কুলে দিদি আমার সাথে কথা বলে।আমাকে খেলতে নিয়ে গিয়ে সব অচেনা ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। কেউ আমাকে মারলে দিদি তাকে বকুনি দেয়। এইভাবেই এই দিদিটি আমার বান্ধবী হয়ে ওঠে। জীবনের একদম প্রথম বান্ধবী।

দিদিকে এই স্কুল ছাড়তে হল, যখন সে ক্লাস ফাইভে উঠল। দিদির সাথে সেভাবে আর গল্প করা হয় না। ক্রমে আমাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। আমিও অন্য একটা হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। দিদির সাথে আর দেখা হয় না। একই গ্রামে বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও যাতায়াতের পথ ভিন্ন হওয়ার দরুণ এই করুণ পরিণতি। তবে সময়ের সাথে সাথে নতুন বান্ধবীদের পেয়ে দিদির কথা একদম ভুলেই গেলাম। কিছুদিন পর দিদিকে দেখলাম। আমার বাড়ির পাশ দিয়েই দিদি স্কুলে যায়। আসলে দিদি তো ইলেভেনে পড়ে, তাই আবার একটা অন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছে। দিদি যখন রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যায়, আমি শুধু দেখি তাকে। সেও আমাকে কিছু বলেনা। আমি সাহস করে এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে পারিনা। দিদি খুব গম্ভীর থাকে। আর এই কারনে দিদি দেখতে সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও কোনও ছেলে দিদিকে কোনও কিছু বলার সাহস পায় না। এমনকী গ্রামের অনেকেই দিদি কে খুব ভালোবাসে তার ঐ ভদ্র ব্যবহারের জন্য ।

আমি ক্লাস টুয়েলভ তে উঠলাম। কিছুদিন পর শুনলাম, ওই দিদিটার বিয়ে হয়ে গেছে। আরও দু-তিন মাস পর শুনলাম, দিদির শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তার ওপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার করছে। দিদি কিছু দিন মুখ বুজে সহ্য করে। পরে আর সহ্য করতে না পেরে বাবার বাড়ি তে চলে এল। এখানে তার মা তাকে দিন-রাত বুঝিয়ে বুঝিয়ে তার কান ঝালাপালা করে দেয়। আর দিদি ঠিক মুক্তমনা নয়। তাই নিজের কষ্ট নিজের মা কে বুঝিয়ে বলতে পারে না। কিছুদিন পর দিদি শ্বশুর বাড়ি চলে গেল। ঠিক তিন দিন পর দিদির মৃত্যুর খবর এল। দিদির মৃত্যু যদি সাধারনভাবে হত, তাহলে আমার এত কষ্ট হত না। দিদির শ্বশুর বাড়ির লোকেরা দিদির পুরো শরীরে অ্যাসিড ছুঁড়ে দিয়ে ছিল। দিদির মুখ বন্ধ হয়ে গেল চিরকালের জন্য। দোষীরা সাজা পেয়েছে।

তবু আজ আমি এত বন্ধু-বান্ধবীর ভিড়ে থেকেও ওই দিদি কে খুব মিস করি। নতুন স্কুলে অচেনার ভিড়ে সেই প্রথম এগিয়ে এসেছিল আমাকে সঙ্গ দিতে। আমার ভয় কাটিয়েছে। এমনকী এই কিশোর বয়সে নিজের গাম্ভীর্য বজায় রাখতে শিখেছি তাকে দেখেই। ওই দিদিটাই আমার স্কুল জীবনের প্রথম বান্ধবী।



"প্রথম বান্ধবী" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না । আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।


মেহেদী হাসান পিয়াস 


No comments

Powered by Blogger.