প্রায়শ্চিত্ত
![]() |
প্রায়শ্চিত্ত - Green Vivacity |
কলকাতার একটা হাইওয়ে। হাইওয়ে টার দু দিকে গাছ গুলো যেন সবুজ ছাতা ছড়িয়ে রেখেছে। দিনের বেলায় গেলেও সবুজ শান্তির ছোঁয়ায় প্রান জুরিয়ে যায়। এই রাস্তা টা আবার ভারত বাংলাদেশের সাথে যুক্ত বলে, প্রায় সবসময় ব্যস্ত। তাই এই রাস্তা টা দিয়ে সব সময় বড় বড় ট্রাক, মালবাহী গাড়ি, যাত্রিবাহী বাস যাতায়াত করছে। বলতে পারেন একটা ব্যস্ত রাস্তা।
রাস্তা কিন্তু অনেক বিবর্তনের সাক্ষী। যোগাযোগের মাধ্যম। কতো ঘটনা ঘটে যায় প্রতিনিয়ত এই রাস্তার বুকে ! কজন তার খোঁজ রাখে। তাই তো বোধহয় আজকাল ট্রাফিক কিয়োক্সে গান বাজতে শোনা যায়, "এই পথেই জীবন, এই পথেই মরন আমাদের, সবকিছু পথের বুকেই"।
সন্ধ্যা নামছে। বিক্রমের আজ হাইওয়ে পেট্রোলিং ডিউটি। বিক্রম। পুরো নাম - বিক্রম সিংহ। ট্রাফিক সার্জেন্ট। কলকাতা পুলিশে চাকরি রত। রাতের বেলায় হাইওয়েতে ওরা চারজনের টিম গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। লক্ষ্য রাখবে কোনো অঘটন না হয়। আর মাঝে মাঝে সন্দেহ জনক গাড়ি গুলোর বৈধ কাগজ পত্র আছে কিনা ইত্যাদি বিষয় গুলো দেখবে ? ছ'ফুটিয়া বিক্রম। দুর্দান্ত ফিগার। বয়স পঁয়ত্রিশ। চাকরি হয়ে গেল প্রায় বারো বছর। বিবাহিত। স্ত্রী এবং একটি মেয়ে নিয়ে তার সংসার। মেয়ে ক্লাস ওয়ানে এ পড়ে। বছর ছয় বয়স। স্ত্রী অয়ন্তিকা। যেখানে ওদের চেক পোস্ট। সেখান থেকে দু কিলোমিটার দূরে বিক্রমের বাড়ি। ঝা চকচকে বাড়ি, মার্বেলের ফ্লোর। গাড়ি বাড়ি নিয়ে বিক্রমের মোটামুটি ভরপুর সংসার।
আজ সন্ধ্যায় অয়ন্তিকার বান্ধবীর বিবাহ বার্ষিকী। ওদের সবার নিমন্ত্রণ ছিল। কিন্তু কাজের জন্য বিক্রম যেতে পারবে না। তাই অয়ন্তিকা আর মেয়ে অনিকে ড্রাইভার নিয়ে গেল। আর বিক্রম চলে আসলো তার কাজের জায়গায়। ওদের ফিরতে আজ একটু রাত্রি হবে।
কাজের জায়গা, কাজের জায়গাও বটে। গাড়ি গুলো গম গম আওয়াজ করতে করতে আসছে। বিক্রম এর তত্ত্বাবধানেই কাজ হবে সন্ধ্যা আট টা থেকে সকাল পাঁচ টা অবধি। তাঁর সাথে রয়েছে দু জন কনস্টেবল আর দুজন অস্থায়ী সিভিক পুলিশ। এভাবেই কাজ হবে সারারাত।
মাঝে হয়তো গাড়ি তে বসে বসে একটু চোখ লাগিয়ে নেওয়া। লাইসেন্স ঠিক ঠাক না থাকলে কাগজের গন্ডগোল থাকলে ওরা ড্রাইভার কে নিয়ে আসেন বিক্রম বাবুর কাছে। বিক্রম বাবু মহান বিক্রমের সাথে পর্যবেক্ষন করে কেস দেন, আবার কখন হাত গরম করে ছেড়ে দেন। সেই সব হাত গরমের পয়সা মোটামুটি একটা নিয়ম অনুসারে ভাগ হয়ে যায়। হাত গরম হয়ে গেলে ঠিকঠাক। মদ্যপ চালক। হেভি লোডেড ট্রাক পার পেয়ে যায়। এভাবেই চলে যায় ডিউটি।
রাত তখন সাড়ে দশটা মতন হয়েছে। বিক্রমরা ওদের পেট্রোলিং এর জীপ টাকে একটা রাস্তার ধারে গাছের নীচে লাগিয়ে হেড লাইট অফ করে রাখল। দূর থেকে হেডলাইট অন করে এগিয়ে আসছে একটা ট্রাক। ওদের সামনে আসতেই টর্চ মেরে দাঁড় করানো হলো গাড়ি টাকে। ট্রাকে রয়েছে কাঠ বোঝাই। গাড়ির চেহারা দেখে অভিজ্ঞ বিক্রমের বুঝতে অসুবিধা হয় না। যে গাড়ি তার ওজন সীমার বাইরে লোড নিয়েছে।
"কি রে এত মাল চাপিয়েছিস কেন রে ?"
"বাবু মালিক নে চাপা দিয়া" চালক বলে।
চালকের কথা গুলো কেমন নেশাগ্রস্থের মতো শোনায়।
"নীচে উতরো। কাগজ লেকে আও"। বিক্রম আদেশ দেয়।
ড্রাইভার আর সহিস কাগজ পত্র নিয়ে আসে টলতে টলতে। মুখ দিয়ে মদের গন্ধ ভক ভক করে বেরোতে থাকে।
দেখে গাড়ির কাগজ পত্র মোটামুটি ঠিক। কিন্তু গাড়ি তাঁর সীমার বাইরে লোড করা হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স টার ভ্যালিডিটির তারিখ টাও বোঝা যাচ্ছে না।
বিক্রম বলে,"তোমার লাইসেন্স টা কিছু বোঝা যাচ্ছে না। গাড়ি ওভার লোডেড। তুমি আগে যাকে ফাঁড়ি মে গাড়ি লাগাও। কাল সকালে চেক করে ছাড়বো। আর যা মাল খেয়ে রেখেছো, তোমার দ্বারা গাড়ি চালানো হবে না।"
ড্রাইভার বিক্রমের কানে কানে কিছু বলে। "চালা লেঙ্গে সাহাব।" ড্রাইভার বলে - সকালে তাকে মাল পৌঁছাতেই হবে। "সাহেব জানে দো।"
"তুমি যে পরিমাণ মাল টেনেছো। তুমি চালাতে পারবে না গাড়ি।" ড্রাইভার বিক্রম সাহেবের হাতে বেশ কটা একশ টাকার নোট গুঁজে দেয়। হাত গরম। বিক্রম বলে "আরো ছাড়ো।" আরো কয়েকটি নোট হাতবদল হয়।
বিক্রম টাকাগুলো বাঁ পকেটে চালান করে দেয়। "শোনো, ছেড়ে দিচ্ছি কিন্তু লাইসেন্স ঠিক করিয়ে নেবে। আর গাড়ি ঠিক সে চালাইয়ো।" সাবধানি সে......
"কিরে অয়ন্তিকা, তোর বর কে দেখছি না ?" বান্ধবীর বিবাহ বার্ষিকী অনুষ্ঠানে বান্ধবী অয়ন্তিকা কে প্রশ্ন করে।
"কি মিষ্টি মেয়ে, কত বড়ো হয়ে গেছে রে তোর মেয়ে।" একটু গাল টিপে আদর করে দেয় সই।
"আর বলিস না সই। কাজ পুলিশের। বৌকে আদর করার সময় ডাক এলেও ছুটতে হবে ! বুঝলে।"
সবাই হেসে ওঠে একসাথে।
"তাহলে খেয়ে টেয়ে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পর। রাতের দিকে ট্রাক ড্রাইভার গুলো খুব রাফ চালায় রে। তোর ড্রাইভার খেয়েছে ?" সই বলে।
"হ্যাঁ রে। আমাদের হয়ে গেছে। সই রাতটা ভালোভাবে কাটিও। তোর বর কোই দেখছি না যে ?"
"ও একটু ওর দুটো বন্ধু কে ছাড়তে গেছে। তুই বেরো এবার। আবার আসিস।"
অয়ন্তিকা ওর মেয়েকে নিয়ে গাড়ি করে বাড়ির পথ ধরে। "সাবধানে চালিও কেমন রাত হয়ে গেল অনেক" । অয়ন্তিকা ড্রাইভার কে বলে।
আবার হাই রোড। গাড়ি এগোতে থাকে। মারুতি সুইফট। খুব বেশি দিন হয়নি। তাই নূতনই। গাড়ি এগোতে থাকে। গাড়ি গিয়ে হাই রোডে ওঠে।
"স্যার, ড্রাইভার টা কে তো ছেড়ে দিলেন। প্রচুর মাল খাওয়া ছিল স্যার। কে জানে শালা কোথাও ঠুকে না দেয়।" বিক্রমকে তার অধস্তন কনস্টেবল বলে। বিক্রম বাঁপকেটে হাত দেয়। আহা, কি সুন্দর অনুভূতি এই টাকার !
তখনই হঠাৎ বিক্রমের ওয়াকি টকি টা বেজে ওঠে।বিক্রম কথা বলে। অ্যাকসিডেন্ট ! তারপর বিক্রম চিৎকার করে ওঠে।
"তাড়াতাড়ি গাড়ি আনো একটা ট্রাক আর প্রাইভেট কার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে এইমাত্র। শালা আমাদের ট্রাক টা নয় তো ! চল তাড়াতাড়ি।"
অ্যাকসিডেন্ট স্পটটা বিক্রমের বাড়ি থেকে একটু খানি দূরে। পৌঁছাতেই দেখে একটা ট্রাক একটা মারুতি সুইফটসকে প্রায় পিষ্ঠ করে। সামনের একটা দেওয়ালে ঢুকে গেছে। ট্রাকের পেছন টা শুধু দেখা যাচ্ছে। ট্রাক টা চেনা চেনা লাগছে বিক্রমের। হ্যাঁ সেই ট্রাক টাই। আর সুইফটার ডান দিক টা মোটামুটি একদম চেপে গেছে। মনে হয় ট্রাক টা উঠে গেছিল। আর একটা পুলিসের টিম দাঁড়িয়ে আছে। বিক্রম ছোটে গাড়ি টার কাছে। খুব চেনাচেনা লাগছে গাড়ি টা। জায়গাটা অন্ধকার। টর্চ মারতেই বিক্রম যেন ভূত দেখলো। কিছুক্ষন তাঁর বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। তারপর একটা আকাশ ফাটানো চিৎকার অনি - অয়ন্তিকা। এ কি সর্বনাশ ! এটা তো আমার গাড়ি। সে বিস্কোরিত চক্ষে অন্য টিম ইনচার্জ কে জিগ্যেস করে, "স্যার কখন হলো ?" "অনি , অয়ন্তিকা ওরা কোথায়। কেমন আছে। বেঁচে আছে তো !" অস্ফুট আর্তনাদে এবং হাহাকার করে ওঠে বিক্রম।
"কুড়ি মিনিট মতো হবে। ড্রাইভার তো স্পট ডেট।একজন মহিলা, একটা ছোট্ট মেয়ে আর সহিস টাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে এস. কে. এম. হাসপাতালে নিয়ে গেছে । ওরা বেঁচে ছিল তখন অবধি।" বিক্রম বলে "গাড়ি আনো জলদি জলদি । জলদি জলদি চলো।"
রাতের অন্ধকারের নিঃশ্তব্দটাকে খান খান করে ছুটছে, আওয়াজ তুলে একটা পুলিশের পেট্রল ভ্যান এবং তার কিছু আগে একটা অ্যাম্বুলেন্স। তিনটে রক্তাক্ত প্রাণ আর দুটো লাশ নিয়ে। পুলিশের প্রেট্রোলিং ভ্যানে বসে বিক্রম অনুভব করছে প্যান্টের বাঁপকেটের ভেতরে নোটগুলো যেন জ্বলছে। আর তাপ পৌঁছে যাচ্ছে সিধে তার হৃৎপিন্ড অবধি। সেও জ্বলছে...... চোখের কোণ ঘেঁষে বেরিয়ে আসছে জল। জল তো নয় সে আগুন যেন। সে আগুন সম জল, যেন অন্তরাত্মা কে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। মনে মনে ভগবান কে বিক্রম বলতে থাকে "একবার প্রভু ! শুধু একবার ! এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দিয়ো ভগবান একবার ।"
বিক্রম দু হাতে মুখ ঢেকে মৌনতার সাথে বারবার এই প্রার্থনা করে যাচ্ছে, "আমার পাপের ফল ওদের দিয়ো না প্রভু। প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোগ দিও ভগবান।"
গাড়ি দুটি এগিয়ে চলেছে হসপিটালের দিকে..........
........সমাপ্ত
"প্রায়শ্চিত্ত" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
No comments