জীবনের গল্প
![]() |
জীবনের গল্প - Green Vivacity |
একজন রোজ খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলব আজ। রিক্সাওয়ালা। হ্যাঁ একদম প্যাডেল ঠেলা পাতি রিক্সাওয়ালার কথা। যার রোজগার-টা নির্ভর করে তার প্যাডেল ঘোড়ানোর ওপরে। আর কেমন প্যাসেঞ্জার পেল তার উপরে। মানে তার ভাগ্যের চাকা-টা ঘুরবে, তার রিক্সার চাকা কেমন ঘুরবে তার উপর।
এরকম এক রিক্সা ওয়ালা যে ভাড়ার রিক্সা চালায় । মালিকের কাছ থেকে রোজ পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে সে রিক্সাটার চালকের আসনে আসীন হতে পারে। চলুন এই রিক্সা ওয়ালা টার একটা নাম দেওয়া যাক। ধরা যাক ওর নাম "জীবন"। জীবনের অনেক গল্পই তো সে দেখে আর শোনে চুপ করে তাই জীবনই দিলাম নাম ওর।
দরিদ্র জীবনের ছোট্ট সংসার। এক ছেলে আর বৌ । ভোর হতেই বেরিয়ে পড়েছে সে বাড়ি থেকে, বৌ আর তার ছোট্ট দু বছরের ছেলে তখনো ঘুমোচ্ছিল। তাদেরকে রেখে। চোখে মুখে জল দিয়ে সে বেরিয়ে পড়েছে তার টালির ভাড়া বাড়িটা থেকে। মালিকের বাড়ি থেকে রিক্সা নিয়ে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছে। এক ফাঁকে কালার দোকান থেকে জীবন একটা লাল চা আর বিস্কুট খেয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন মহিলা একটি ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে এল। স্কুল ড্রেস পরা। বলে উঠলেন, "যাবেন দাদা - রেল গেট"
জীবন ঘাড় নাড়ে হ্যাঁ বাচক। আর প্যাডেল মারা শুরু করে। মহিলা ছেলেকে বলা শুরু করে রোজ রোজ স্কুল বাস মিস হচ্ছে সোনা। দাদা একটু জোরে টানবেন। আজও বোধহয় পাবো না। তুমি কাল আরো আগে উঠবে। পটি করতে অতো সময় নিও না। তোমার বাবা তো ওসব কোনদিনও বুঝলো না। যেন সব ঠেকা আমিই নিয়েছি। দাদা একটু তাড়াতাড়ি চালান না। হ্যাঁ চালাচ্ছি তো ! এর মধ্যে দিদিমণির ফোনটা বেজে উঠলো। ও প্রান্তে বাসের সহিসের ফোন। ম্যাম আপ কাহা। বাস ছুট রহি হ্যায়।
উত্তেজিত হয়ে মহিলা বলে ওঠেন - "দাদা বললাম, একটু তাড়াতাড়ি টানতে বাস চলে গেল দেখলেন তো।" আমি তো টানতেছি দি মনি।
রেলগেট পৌঁছাতে দিমনি আর ছেলে দৌড় লাগালেন। বাস ধরে স্কুল ছেড়ে আসতে হবে। জীবন পনেরো টাকা পকেটে ভরে। আরোও পঁয়ত্রিশ লাগবে মালিকের ভাড়া মেটাতে। মনে মনে বলে একটু তাড়াতাড়ি বেরোলেই তো সমাধান হয়ে যায়। সে রিক্সা ওয়ালা চুপ করে শোনাই তার কাজ। মুখ ফুটে বলে না সে কথাটা।
রেলগেটে এবার অপেক্ষায় থাকবে সে তার পরের প্যাসেঞ্জার এর জন্য। সেখানে আবার লাইনে দাঁড়াতে হবে অপেক্ষায় থাকতে হবে। তার লাইন আসলে সে যাবে। এখন আবার টোটো এসে যাওয়ায় তার মতো রিক্সা ওয়ালাদের আয়ের উৎসে টান ধরেছে। দু চারজন জন এর পর তার লাইন এল । কিছুক্ষণ পরে তার ভাড়া এল। একজন যুবা হাতে একটা কালো ব্যাগ নিয়ে। ট্রেন থেকে নেমে এসেছে সে। যাবে ঝাউ তোলা। "ঝাউ তোলার কোথায় বাবু ?" "প্রদীপ ডাক্তারের বাড়ির চারটে বাড়ি ছাড়িয়ে", সে জানায়। ঝাউ তলা স্টেশন থেকে প্রায় আধা ঘন্টা রিক্সায়। তারপরে গলির ভেতর। জীবন ত্রিশ টাকা চায়। দর কষাকষি করে পঁচিশ টাকায় ভাড়া ঠিক হলো। চলেন বলে, জীবন প্যাডেল ঢেলে।
রিক্সা এগোতে থাকে। রাস্তা খারাপ। রিক্সা লাফাতে থাকে। ব্যস্ত রাস্তা হওয়া সত্ত্বেও এই রাস্তাটা অদ্ভুত। জায়গায় জায়গায় গর্ত। এবড়ো খেবড়ো। ফি বছর বর্ষায় আরো হাল খারাপ। পুজোর আগে কিছু ইটের টুকরো গুতিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া। আবার পরের বর্ষায় আবার যে সেই। ঠিক যেন জীবনের রিক্সার চাকার মতন, একই জিনিসের পুনরাবৃত্তী।
হঠাৎই বাবু মুখ খোলে - আপনি কোথায় থাকেন ? জীবন বলে সে টালি খোলায় থাকে। আচ্ছা, বাবু আপনে কোথা থেকে আসতাছেন। আর বলো না। নাইট ডিউটি আমার। একটা কোম্পানি তে। সারারাত জাগা। আবার বিকালে বেরোতে হবে। "ও তাই"। "হ্যাঁ দাদা, মাঝে মাঝে ভাবি আমি মানুষ না কুত্তা, রোজ রাতে জাগা আর দিনে একটু ঘুমুনো।"
জীবন একটু হাসে। আর বলে ," বাবু সকলেরই কিছু কিছু না কিছু জ্বালা আছে"। কিছুক্ষণের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে, জীবন বলে নামেন বাবু। "ওহো ! এসে গেছি। চোখটা লেগে গেছিল"।
জীবন ভাড়া ট্যাকে গুজতে গুজতে ভাবে,"মানুষ কুত্তা হতে কোনোদিনও পারবে না বাবু। ওরা বেইমানি করে না যে ।" এবার বড় রাস্তা অবধি খালি রিক্সা টানতে হবে। বেলা বাড়তে থাকে। জীবন রিক্সাটাকে একটা রুটির দোকানে লাগায়। তিনটে রুটী , তরকারি আর চা। তারপরে মোড়ের মাথায় একটা তেঁতুল তলায় বসে আবার অপেক্ষা।
এরপরে নানারকম যাত্রী তার রিক্সা তে ওঠে এবং নির্দিষ্ট গন্তব্যে যায়। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে, জীবন শুধু শোনে। কখনো সেই কথা আনন্দে আবেগে উচ্ছল থাকে, আবার কখনো আবার বিষাদময়। কখনো সে কথা আক্ষেপে ভরা, কখনো প্রাপ্তিতে ভরপুর। জীবন শুধু নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে সেই সমস্ত ঘটনা গুলির।
জীবন রিক্সা নিয়ে রেল স্টেশনের ধারে অপেক্ষামান। এমন সময় বছর কুড়ির এক ধোপদুরস্ত ছেলে এসে বলল। চলুন দাদা শনি মন্দির। জীবন আচ্ছা বলে প্যাডেলে চাপ মারে। রিক্সা এগোতে থাকে।
জীবন ভাবতে থাকে বাবুটা কে আগেও কোথায় যেন সে দেখেছে। সে প্রশ্ন করে বাবু আপনাকে যেন আগে কোথায় দেখেছি।
ছেলেটি সহাস্যে বলে - দাদা দু মাস আগে আপনার রিক্সা করে সকাল সকাল স্টেশনে গিয়েছিলাম। একটা চাকরির ইন্টারভিউ ছিল । আজ অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার হাতে পেলাম। আপনি খুব লাকি জানেন, সেদিনও আপনার রিক্সাতে গিয়েছিলাম আজ আবার ফিরছি।
জীবন বলে- লাকি ! লাকি হলে বাবু আমি রিক্সা চালাতাম। বাবু ! আপনি মেহনত করেছেন, তাই চাকরি পেয়েছেন বাবু। খুবই আনন্দের কথা। ভালো থাকেন।
কথায় কথায় গন্তব্যে পৌঁছে যায় তারা। ছেলেটি নামে রিক্সা থেকে এবং জীবন কে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ধরায়। জীবন কে বলে - রাখুন টাকাটা, বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে যাবেন। জীবনের কোন আপত্তি ছেলেটা শোনে না। জীবন টাকাটা নেয়। মন ভরে ভগবানের কাছে ছেলেটির ভালো থাকার জন্য প্রার্থনা করে।
রাত অনেক হলো। এইবার জীবন বাড়ি ফিরবে। প্রথমে সে মালিকের পঞ্চাশ টাকাটা আলাদা করে। তারপর বাকি পয়সা গুলো গোনে। জীবন চলতে চলতে ভাবতে থাকে। এবার একটু পয়সা জমলে নিজের জন্য একটা রিক্সা কিনবে সে। আর বৌটার জন্য একটা লাল টুকটুকে তাঁতের শাড়ি। ছেলের জন্য দশের হাট থেকে সুন্দর জামা প্যান্ট। নিজের জন্য একটা বারমুডা। আর ভাবতে থাকে সেও তার ছেলেটাকে পড়াবে যাতে একদিন সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবার মতন শুধু জীবনের গল্প না শুনে জীবন টাকে একটা নতুন দিশা দিতে পারে।
এ ভাবেই স্বপ্ন সাজাতে সাজাতে চলতে থাকে অহরহ জীবনের পথচলা।
........সমাপ্ত
"জীবনের গল্প" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
No comments