গরমের ছুটিতে
![]() |
গরমের ছুটিতে - Green Vivacity |
আমার মামার বাড়ি বর্ধমানের আউষগ্রাম। মামাদের দশ পুরুষের বাস। চাষবাস আছে, পুকুরে অনেক মাছও আছে। মামা হাইস্কুলে অঙ্ক শেখান। আমি ভালো অংক পারি। তাছাড়া মামার একটা মাত্র ভাগ্নী। মামা আমায় খুব ভালোবাসেন। আমিও মামাকে খুব ভালোবাসি। তাই ঠিক করেছিলাম এবার স্কুলের গরমের ছুটিতে মামার বাড়িতে গিয়ে খুব মজা করব। মা-বাবা দুজনেই কেন্দ্রীয় পারমাণবিক সংস্থার বিজ্ঞানী। ছুটি নেই। গড়িয়া থেকে আউষগ্রাম কতই বা দুর। বাবা ট্রেনে তুলে দিলেন হাওড়ায় আর মামা নামিয়ে নিলেন আউষগ্রাম। দারুণ কাটাচ্ছি দিনগুলো। পুকুরে ছিপ ফেলা, গল্পের বই পড়া, পিঠে পায়েস খাওয়া আর জব্বর ঘুম লাগানো কাজ বলতে এই। আসলে কিন্তু সবটা বলা হল না। এখানে আসার পিছনে আমার একটা গোপন উদ্দেশ্য আছে। মাস কয়েক আগে মামা যখন আমাদের বাড়ি এসেছিলেন মামা বাবামাকে একটা অদ্ভূত ঘটনা বলেছিলেন।
মামাদের ভাগচাষী জব্বার মামা ক্ষেতে কাজ করছিলেন। সেই সময় হাওয়ায় উড়তে উড়তে একটা জামা এসে পড়েছিল ক্ষেতে। জামাটা খুবই বিচিত্র দর্শন। রাংধনুর সাতটা রঙই কমবেশী জামাটাতে আছে। মামার মনে হয়েছে জামার কাপড়টা কোন সাধারণ কাপড় না, মনে হয় যেন প্রাচীন মিশরীয় পেপার জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি। সামান্য দু একজন জামাটার কথা জানে। বাইরে এখনও প্রচার হয় নি।একটা বোতামহীন জামা। জামাটার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট হচ্ছে অত চমৎকার এবং বৈচিত্র্যময় জামা আজ পর্যন্ত কেউ গায়ে পরতে পারে নি।
বয়স্ক কেউ যদি পরতে যায় জামাটা আপনা আপনি এত ছোট হয়ে যায় যে লোকটার মাথা গলা দিয়েই ঢোকে না। আবার কোন ছোট ছেলে বা মেয়ে পরতে গেলে এত ঢলঢল করতে থাকে যে তখন মনে হয় ওরকম দশটা বাচ্চা ভিতর দিয়ে গলে যাবে। বাবা শুনে হো হো করে লাগলেন বললেন, "আমার শালা আজকাল গাঁজাটাঁজা খাচ্ছে নাকি !" আর মা মুচকি মুচকি হাসছিলেন। পরে মামা রেগে যাওয়ায় বোধহয় শান্ত করার জন্যই বললেন, "ঠিক আছে,ঠিক আছে। আমরা আউশগ্রাম গেলে দেখাস। এখন চল খেতে বসি সবাই মিলে।" আমি কিন্তু ভুলি নি।
গরমের ছুটিতে বন্ধুদের ছেড়ে শুধু মাছ আর আম খেতে আউষগ্রাম আসি নি। জামাটার রহস্য ভেদ আমায় করতেই হবে। এখানে আসার পরের দিনই মামা মামিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম জামাটা সম্পর্কে। মামা তো এড়িয়ে গেলেন। মামিমা বললেন, "ওই ভূতুড়ে জামা নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। তার থেকে মাছ ধরো, গল্পের বই পড় আর রাতে মামার কাছে অঙ্ক কর। ভালো না লাগলে টি ভি দেখো, আমাদের সঙ্গে গল্প কর।" কিন্তু জামাটা আমার মন থেকে গেলো না। দুপুরে স্কুল না থাকলেও মামা বাড়ি থাকেন না। মামিমাও ঘুমোন।
এই সময় আমি গোটা বাড়িটা তন্নতন্ন করে মামাবাড়ির সমস্ত ঘর-বার আনাচে কানাচে জামাটা পাগলের মত খুঁজতে লাগলাম। কোনো লাভ হলো না। ইতিমধ্যে ছুটিও শেষ হতে চলল। আর দিন পাঁচেক বাকী। হঠাৎ আমার মনে হল আচ্ছা ছাদের নীচে যে মাচান আছে সেখানে দেখা হয় নি তো। কিন্তু আমি ওটায় উঠব কেমন করে ! ভাবতে ভাবতে নজরে পড়ল মই টার দিকে। মামা বাড়ির বাইরে, মামী ঘুমোচ্ছেন। আমি মই বেয়ে মাচায় উঠে গেলাম। কত পুরণো সব জিনিসপত্র জড়ো করা আছে। হাতে সময়ও বেশী নেই। মামা বিকেলের আগেই ফিরে আসেন মামীও জেগে যান।
আমি পাগলের মত হাতড়াতে শুরু করলাম। অদ্ভূত ব্যাপার। একটু পরেই মনে হল জায়গাটা হটাৎ সাদা হয়ে গেল। তারপরই জামাটা চোখে পড়ল। ঠিক যেমন শুনেছিলাম। পুরণো কাগজের উপর যেন মনে হয় রাংধনুর সাত রঙ লেগে কখনো সাদা হয়ে যাচ্ছে, কখনও সাত রঙ আলাদা আলাদা দেখা যাচ্ছে। আমি জামাটা পরে দেখব বলে হাতে নিতেই একটা বাচ্চা মেয়ে যেন জামার ভিতর থেকে আমার নাম ধরে ফিসফিস করে বল্ল, "রাকা,আমি তো তোমার জন্যেই অপেক্ষা করে আছি। তুমি তো কখনও মিথ্যা কথা বল নি। তোমার গায়ে দেখবে এটা কি সুন্দর ফিটিং হয়। আর তারপরই দেখবে কি মজা হয়।
তুমিও আমার মত পরী হয়ে যাবে।" আমি বোতামহীন জামাটা মাথা দিয়ে গলিয়ে উঠে দাঁড়াতেই বুঝতে পারলাম আমার গোটা শরীরটা খুব খুব হালকা লাগছে আর আমার শরীরের দুপাশ দিয়ে পাখা গজিয়েছে। কি হল ! প্রথমটা অবাক হয়ে গেলেও সামলে নিলাম। আয়নায় একবার নিজেকে দেখা দরকার ভেবে মাচার কিনারায় এসে শরীর ছেড়ে দিলাম। মই ছাড়াই পালকের মত ভাসতে ভাসতে মেঝেতে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। আমি সত্যি সত্যিই সাদা রঙের পাখনাওয়ালা একটা পরী হয়ে গেছি। আমি নাচতে নাচতে বাইরে বেরিয়ে গেলাম।
কি সুন্দর গাছের মগডালেও উড়ে গিয়ে বসতে পারছি। কি মজা কি মজা। এ গাছের থেকে ও গাছে তারপর আর এক গাছে। উড়তে উড়তে একটা বড় শহরে পৌঁছে গেলাম। কত লোকজন বিরাট বিরাট বাড়ি, ঘর, মল আর অফিস। বুঝলাম এটাই বর্ধমান। দোকানের সাইনবোর্ড দেখেও বুঝলাম। এক জায়গায় দেখলাম একজন ফুচকাওয়ালা ফুচকা বিক্রী করছেন আর তাকে সবাই ঘিরে আছে। আমি ফুচকা খেতে এত ভালোবাসি। ডানায় ভর করে নেমে গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফুচকাওয়ালা অন্যমনস্ক ভাবে আমাকে শালপাতা এগিয়ে দিলেন।
তারপর আমার দিকে চোখ পড়তেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মুখ হা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হটাৎ আমার শালপাতায় ফটাফট ফুচকা এগিয়ে দিতে লাগলেন। আমি বললাম, "আমার তো পয়সা নেই।" ফুচকাওয়ালা বললেন, "তুমি পরী দিদি আছো তোমার আবার পয়সা কিসের। কটা খাবে খাও না।" আমি পটাপট কুড়িটা ফুচকা খেয়ে নিলাম। বাকীরা ফুচকা খাওয়া ছেড়ে আমায় দেখছে। কেউ কেউ আমার ডানাদুটো পরখ করে দেখছে। আমাকে ঘিরে ভীড় বাড়তে লাগল। বুঝলাম এখানে আর থাকা নিরাপদ নয়। আমি আবার ফুস করে উড়ে গেলাম। বর্ধমানের আকাশে পাক খেতে লাগলাম।
একটা খুব বড় মিষ্টির দোকানে দেখলাম বর্ধমানের আসল মিহিদানা, সীতাভোগ আর শক্তিগড়ের আসল ল্যাংচা বিক্রী হয় বলে লেখা আছে। খুব ভীড়। মা আর মামার কাছে এত গল্প শুনেছি। সাহস করে নেমে পড়লাম। প্রায় একই রকম ঘটল। দোকানদার প্রথমে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেও আমাকে খুব আদর করে দোকানের মালিক জেঠুটা মিহিদানা, সীতাভোগ আর ল্যাংচা খাওয়ালেন । কি আনন্দ ! কিন্তু আমাকে ঘিরে ভীড় বাড়তে থাকায় আমি আর বেরোতে পারছিলাম না। একটা সত্যিকারের পরী !একটু ফাঁক পেতেই ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে আবার একটা বট গাছের মগডালে গিয়ে বসলাম।
আবার আকাশে চক্কর দিতে শুরু করলাম। বর্ধমানের বিখ্যাত সেনশর্মার রেস্টুরেণ্ট নজরে পড়ল। মা এর মুখে এখানকার মাটন বিরিয়ানির এত নাম শুনেছি ! কিছুতেই লোভ সামলাতে পারলাম না। খেতে গিয়ে একই রকম খাতির আর বিড়ম্বনা জুটলো। যাই হোক ! যা খেয়ে নিয়েছি দুদিন আর না খেলেও হবে। পেট আইঢাই করছে। আমি একটা শিরিশ গাছের উপর উড়ে গিয়ে বসলাম। এদিকে আমার কথা বোধহয় চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন ভয় ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে যদি আগের মত ছোট্ট স্কুলে যাওয়া রাকা হয়ে যেতে পারতাম। নীচে হাজার হাজার লোকের ভীড়।
তাঁরা আমায় মানে পরী দেখতে এসেছে। পুলিস, অ্যাম্বুলেন্স, দমকল। দেখে মনে হয় পুলিসের কোন হোমরাচোমরা হবে । হাতে মাইক নিয়ে বাঙলা, হিন্দি ও ইংরেজি তিন ভাষাতেই ঘোষনা করতে লাগলেন, "পরীখুকু তুমি যেখান থেকেই এসে থাক তুমি তাড়াতাড়ি নেমে এসে আমাদের সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দাও। তুমি ভারত ভূখন্ডে আছো, এখন পূর্ণ ভারতীয় একজন শিশু।" শুধু এ রাজ্যের রাজ্যপাল বা মূখ্যমন্ত্রী নয় ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীও তোমার কথা শুনে তোমায় দেখতে চাইছেন।"
এতে আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম। মা-বাবা কারোর নাম মনে করতে পারলাম না মুখ তো দূরের কথা। আবেদনে কোনো কাজ হল না। গুড়িসুুড়ি মেরে শিরিস গাছের উপর বসে আছি দেখে দুজন কমবয়সী পুলিস তরতর করে গাছ বেয়ে উঠে এল আমায় ধরতে। কিন্তু কাছে আসার আগেই আমি ফুরুৎ করে উড়ে গিয়ে অন্য গাছের আগায় গিয়ে বসলাম। এরকম বেশ কয়েকবার হওয়ার পর ওরা হার মেনে নতুন এক কায়দা নিল। পাইপে করে বরফ ঠান্ডা জল আমার গায়ে স্প্রে করতে শুরু করল। ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আমি আরো গুড়িসুড়ি মেরে গেলাম।
হি হি করতে করতে নিজের গায়ের ভেজা সাতরঙা পরীর জামাটা প্রাণপন জড়িয়ে ধরলাম দু হাতে গাছের একটা মোটা ডাল সমেত। ওরা হেরে গেল, আমায় নামাতে পারল না। এরপর ওরা মুখ সরু লম্বা লম্বা পাইপ দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আমার গায়ে ছুড়তে লাগল প্রবল বেগে। এরই মধ্যে অনেক উচু আকাশে প্রচন্ড ঠান্ডায় আমি কয়েকবার পাক খেয়েছি। ফলে ঠান্ডা হাওয়া ছুড়ে আমাকে কায়দা করতে পারল না। আমি ঠিক আগের মতই হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে পরীর জামাটা গায়ের সাথে জড়িয়ে রাখলাম আর গাছের একটা মোটা ডাল আঁকড়ে ধরে রইলাম।
এবার ওরা একদম উল্টো রাস্তায় হাঁটা দিল। গাছটার নীচে গাছটাকে ঘিরে আমায় তাক করে পাইপে করে গরম হাওয়া ছুড়তে লাগল। কি অসহ্য গরম ! আমার গোটা শরীর বিশেষ করে ডানাদুটো মনে হচ্ছে যেন পুড়ে যাবে। আর পারছি না। তাড়াতাড়ি সবার আগে পরীর রামধনু জামাটা গায়ের থেকে খুলে ফেললাম। জামাটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আর ঐ আমার পতন শুরু হল। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে শিরিস গাছ থেকে নিচে মাটিতে পড়ে গেলাম। আমার জ্ঞান ফিরল আমি হাসপাতালে শুয়ে। আমার মা-বাবা মামা-মামী আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে।
পরে শুনে ছিলাম মামা বাড়িতে ফিরে মাচার গায়ে মই লাগানো দেখে মামা উপরে উঠে দেখেন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছি। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে মা-বাবাকে খবর দিলে তাঁরা গাড়ি চালিয়ে ছুটে আসেন। আমি নাকি ছ-ঘন্টার উপরে অজ্ঞান ছিলাম। ডাক্তারদের সন্দেহ আটক জায়গায় গরমে আর কোন অজানা বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। আমি কোলকাতায় ফেরার আগে মামা আমায় রাংধনু জামাটার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সত্যি বললে কেউ বিশ্বাস করবে না আর মিথ্যেকথা আমি বলি না। তাই চুপ করেই ছিলাম। তবে আপনাদের বলি জামাটার রহস্যের আজো আমি "উত্তর খুঁজে পাই নি।"
........সমাপ্ত
"গরমের ছুটিতে" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
©
Nice story
ReplyDeleteNice story dada
ReplyDeleteGood Story
ReplyDeleteNice♥️♥️
ReplyDeleteNice Story ������
ReplyDelete