বোধন

বোধন - Green Vivacity

      " এ বারের দুর্গাপুজোয় কিন্তু আমায় কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে।" গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে অফিস থেকে সদ্য ফেরত আসা জয়ন্তকে বলে উঠলো নীরা। জয়ন্ত ও নীরার সাত বছর দাম্পত্য জীবনে একবারও দেশে মানে India তে আসাই হয় নি। সেই বিয়ের পর থেকেই ওরা ইউএসএ তে। প্রথমে জয়ন্ত রাজি হয় নি , তার পর নিরার সেই এক রাশ নালিশের চাপে হ্যাঁ বলতে বাধ্য হল। জয়ন্তদের কলকাতার নিজের বাড়িতে পুজো হয়। কিন্তু অফিসের কাজের চাপে আর ছুটি নেওয়া হয় নি। এই দম বন্ধকর জীবন যে জয়ন্তর ভালো লাগে, তা নয়। কেবল ছুটি মেলাই ভার। এই কথোপকথন চলার ফাঁকে তাদের পাঁচ বছরের পুত্র সোহম বলে উঠল ," বাবা, দুগগা কি ? আমি দুগগা দেখব।" সোহম আগের বছর দুর্গাপুজো দেখেছে Bowling Green এ তবুও শিশু তো তার কি আর মনে থাকে !

যাইহোক অতি কষ্ট করে জয়ন্তর দিন ১৫ ছুটি মিলে গেল। স্ত্রীর রণরঙ্গিণী রূপ থেকে বাঁচা যাবে এই ভেবে আশ্বস্ত হল জয়ন্ত। অবশেষে পঞ্চমীর দিন কলকাতায় ফেরা হল বাড়ির ছেলে , বউ, নাতির। তাই আনন্দে ডগমগ দেবরায় বাড়ির কর্তামশাই। ছোট্ট সোহমকে 'দাদুভাই' বলে কোলে তুলে নিলেন তিনি। দাদুর আদর খেতে খেতে ,ঠাকুরদালানে কিছু অদূরে বসে থাকা আরও একটি বালকের দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করল সোহম ,"এ কে?" বালকটি আসলে তাদের বাড়ির পুরোহিত নিত্য বাউনের ছেলে কানাই। বয়স তার বছর দশেক।

কানাইয়ের পৃথিবী অন্ধকার। কারণ সে জন্মান্ধ । দাদুকে প্রশ্ন করার পরে ,উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে কোল থেকে দ্রুত নেমে গিয়ে ,কানাইয়ের কাছে ছুটে গেল সে। গিয়ে সে বলল ," আমার সাথে খেলবে?"
_ "তুমি কে গো?"
_" আমি সোহম । তোমার ফ্রেন্ড।"
ফ্রেন্ড শব্দটার অর্থ কানাইয়ের জানা । সাধারণ - স্কুল যেতে অক্ষম ছিল সে। কিন্তু শিক্ষা বাড়িতে দেওয়া হত। ইংরেজি মাসটার নিয়মিত এসে তাকে নতুন শব্দ শেখায়। যথসামান্য পুঁজি দিয়ে সন্তানকে যতটা ঠিক রাখা যায় সেই চেষ্টাই করত নিত্য বাউন। একবার দেবরায় বাবুকে বলেছিলেন যে ছেলের চোখের চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা লাগবে। কিন্তু দেবরায় বাবু দেন নি।

শূন্যপানে চেয়ে কানাই বলে ," আমি কি করে খেলব বল, চোখে দেখতে পাই না যে, আমি অনেক গল্প জানি , শুনবে?"
"কিসের গল্প দুগগার?"
" হ্যা"
এই বলে কানাই তার কানে শোনা গল্পগুল সোহম কে শোনায়। মহিষাসুরমর্দিনী থেকে শুরু করে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী কিছুই বাদ যায় না। কথায় কথায় কি কারণে 'কাশফুল' শব্দটা উঠে আসে , সোহম জিজ্ঞেস করে,' কাশ ' কি?উত্তরে একটি বিশেষ ধরনের ফুল যা শরৎকালে ফোটে ,দেবীর আগমন বার্তা বাহক জানায় কানাই।

এই যে তাদের গল্প শুরু হয়, নিমেশের মধ্যে যেন শেষ হয়ে যায়, দেখতে দেখতে দশমি চলে আসে। ঠাকুরকে গঙ্গার জলে পড়তে এই প্রথম দ্যাখে সোহম। দুঃখে গলাটা যেন বুজে আসে তার। আবার সেই হিমেলা দেশে ফিরতে হবে তাকে। তারপর আবার কানাই, তার খেলার সাথির সাথে আর দেখা হবে না। কানাইয়ের সাথে এই কদিনেই সে অবিছেদ্দ্য টানে জড়িয়ে গেছে সে। কানাই যে চোখে দেখতে পায় না তা বড়ই যন্ত্রণা দায়ক তার কাছে।

এই সব ভাবতে ভাবতে ছোট্ট সোহমের জ্বর চলে এল। এই সব আনন্দের মুহূর্ত ছেড়ে তার একবারও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না । কিন্তু প্লেনের টিকিট ক্যান্সেল করার উপায় নেই।জ্বরের ঘোড়ে সে বলে ওঠে "কানাই ! মা কানাইের কাছে যাবো। "এসব দেখে জয়ন্তর একদম ভাল লাগেনি । এছাড়াও সে পড়ে শুনেছিল যে তার বাবা কানাইয়ের জন্য সাহায্যের হাত বাড়ায় নি। তাই সে ইউ স এ তে ফেরার আগে নিত্য কে ডেকে জানায় যে কানাইয়ের চক্ষু প্রতিস্থাপনের জন্য যা টাকা লাগে সে দেবে। আর মনে মনে স্থির করে প্রতি বছর সে সোহমকে নিয়ে পুজোয় আসবে।

একবছর পর--------

আবারও দেবরায় বাড়িতে সাজ সাজ রব। আজ যে মায়ের বোধন। কানাই এবারে দুচোখ ভরে মৃন্ময়ী মায়ের চিন্ময়ী রূপ দর্শনে রত। সঙ্গে বন্ধু সোহমের অপেক্ষা ।

ওই ত সোহম এসে গেছে। সঙ্গে ক্যাপ বন্দুকও এনেছে। সোহম তার ছোট্ট উষ্ণ হাত দিয়ে কানাইয়ের হাত ধরে নিয়ে গেল, বাড়ির উলটো দিকের , দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে কাশফুলের মাথা দোলানর ছন্দে খেলতে মত্ত তারা। অদূরেই ঢাক বাজছে , মায়ের বোধন সম্পন্ন হল ।

   সমাপ্ত

● "বোধন" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না । আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।


মেহেদী হাসান পিয়াস

No comments

Powered by Blogger.