আত্মহত্যার পথে কৈশোর
![]() |
আত্মহত্যার পথে কৈশোর - Green Vivacity |
আত্মহত্যা অর্থাৎ নিজেকে হত্যা। নিজেই নিজেকে হত্যা। একবার ভেবে দেখুন নিজেই নিজেকে হত্যা করা যায় কী ? মানুষ তো নিজের জীবণকেই সব থেকে বেশি ভালোবাসে। আবার সেই মানুষ কী না নিজেকেই হত্যা করে ! আমাদের একটু কেটে গেলে কতো কষ্ট হয়, পড়ে গেলে কতো ব্যাথা লাগে তাহলে নিজেকে খুন করতে কত ব্যাথা লাগে, কত কষ্ট হয় বলুন তো ? ভাবুন তারপরেও মানুষ নিজেকে হত্যা করে !
সভ্যতা যত উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে এই আত্মহননের পরিসংখ্যান ততো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কারা নিজেকে বলি দিচ্ছে ? নিজেদের ভবলীলা সাঙ্গ করার জন্য ?
এর উত্তর আগের থেকে এখন অনেক বদলে গেছে। আর কষ্টটা সবথেকে বেশি এই বদলে যাওয়া উত্তরের জন্যই। ঢাকা, খুলনা, বরিশাল সব জায়গা থেকেই আসছে উত্তর। কখনো ভালোবাসার উপেক্ষায়, কখনো টিউশন পড়তে না যেতে চাওয়ার জন্য মায়ের বকা খেয়ে, ক্লাস অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রি তো কখনো আবার টিফিন খাওয়া নিয়ে বান্ধবিদের সাথে ঝগড়ার কারনে ১৩ বছরের শিশু নিজেই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। চারিদিকে কেমন যেন শুরুতেই সমাপ্তির বাজনা। যত দিন যাচ্ছে ততো যেন আত্মহননের অন্ধকার ছায়া সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কে গ্রাস করছে।
কিন্তু শুরুতেই শেষ কেন ?
মনস্তত্ত্বের দিক থেকে দেখতে গেলে আত্মহত্যার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল অবসাদ। যা মানুষের মনে বাসা বাধলে নিজেই নিজেকে শেষ করে দেবার ক্ষমতা লাভ করতে পারে। আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে তবে কি অবসাদের কালো ছায়া এই শিশু মনগুলোকেও ছাড়ছে না ? আজকের শৈশব কি তাহলে এতটাই...... ! কোথাও আমার আপনার সন্তানের মধ্যেও আত্মহত্যার কালোছায়া নেই তো ?
WHO এর পরিসংখ্যান বলছে সারা বিশ্বে নাকি ৩০ কোটি মানুষ অবসাদে ভুগছে। এরমধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। জ্বর-সর্দির মতো একটা অসুখ এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কেন ?
যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা এর উত্তর নিতে চাই তাহলে বলব ...........
১) সচেতনতার অভাব : বাংলাদেশের প্রায় সর্বস্তরেই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। মানসিক স্বাস্থ্য পরিসেবার যেমন অভাব রয়েছে তেমনি যেটুকু আছে সেখান থেকে পরিসেবা নেবার মানুষেরও অভাব রয়েছে।
২) গুরুত্বের অভাব : আমাদের শরীরের মতো মনও যে আমাদের শরীরের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তা আমরা অনেকেই মেনে নিতে চাই না। শরীরের যেমন অসুখ করে এবং তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তেমনি মনেরও অসুখ হতে পারে তারও চিকিৎসার প্রয়োজন আছে এটা নিয়ে আমরা ভাবার প্রয়োজনই বোধ করি না।
৩) সামাজিক চাপ : মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে জনমানসে সচেতনতার অভাবে সমস্যা পীড়িত মানুষের উপর একটা চাপ তৈরি করে যা তাকে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বিরত করে। মানুষ মনে করে এই ধরনের চিকিৎসা শুধু মাত্র পাগলদের জন্য অথবা যারা এই চিকিৎসা গ্রহণ করে তারা নিশ্চই পাগল। তাই লোকে কি বলবে এই ভেবেই তারা আর চিকিৎসকের কাছে পৌছাতে পারে না। আর সেই সুযোগেই অবসাদ তাকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।
এবার দেখে নেওয়া যাক শিশুদের আত্মহননের সম্ভাব্য কারণ কি হতে পারে ?
১) অবসাদ : বর্তমান সময়ে সর্বক্ষেত্রেই শিশুদের উপর প্রতিযোগিতার একটা চাপ সর্বক্ষণ বিরাজমান এবং খেলাধূলার পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ায় তাদের স্বাধীন চিন্তা ব্যাহত হচ্ছে। তারা ধীরে ধীরে যেন যন্ত্রমানব হয়ে উঠছে আর এই পরিস্থিতিতেই শিশুদের মনে অবসাদের আগমণ ঘটছে।
২)পারিবারিক একাত্মতার : পারিবারিক একাত্মতার অভাবে শিশু নিজেকে পরিবারের একজন বলে মনে করতে পারছে না। ফলে সে সবসময় নিরাপত্তা হীনতায় ভোগে।
৩) ত্রুটিপূর্ণ সামাজিকীকরণ : সঠিক সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়েই মানব মনে বোধের বিকাশ হয়। যে বোধ শক্তি তাকে তার জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়। সমাজের বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শেখায়। এমনকি বিশেষ পরিস্থিতিতে নিজের সাথে নিজের লড়াই করতেও শেখায়। সামাজিক মূল্যবোধ, সম্পর্কের গভীরতা, গুরুত্ব প্রভৃতি নানান বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে। যা তার জীবনে একটি শক্ত ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে সাহায্য করে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ত্রুটিপূর্ণ সামাজিকীকরণের ফলে সামাজিক মূল্যবোধ, সম্পর্কের গভীরতা, এমন কি নিজের জীবনের ভিত পর্যন্ত এতটাই ঠুনকো হয়ে ওঠে যে সহজেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। খুব সাধারণ ঘটনাতেও ছেলে মেয়েরা এমন ভাবে ভেঙে পড়ছে যে মৃত্যু ছাড়া তাদের কাছে আর কোন পথই খোলা থাকছে না।
এবার দেখে নেওয়া যাক কিভাবে এই সমস্যা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি।
১) প্রত্যেকটা ছাত্র-ছাত্রির শেখার একটা নির্দিষ্ট ক্ষমতা আছে। প্রত্যেকের I.Q. লেভেল আলাদা আলাদা। ফলে আমরা চাইলেই সবাই কে সব কিছু শেখাতে পারিনা। এটা আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা, বাবা-মা সকলেরই বোঝা উচিৎ। আর এটা যদি আমরা বুঝতে না চাই এবং তাকে তার ক্ষমতার বাইরে বেরিয়ে চাপ দিয়ে কিছু শেখাবার চেষ্টা করি তা তো তার উপকারে আসবেই না বরং প্রতিনিয়ত ক্ষতিই হতে থাকবে।
২) বাবা-মাদের নিজের সন্তান কে নিয়ে বিরাট উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করা উচিৎ। কারণ আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আপনার সন্তানের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে।
ভেবে দেখুন আপনার সন্তান হয়তো চাইছে কলা বিভাগে পড়াশোনা করতে ! কিন্তু আপনি তা মেনে নিতে পারছেন না কারণ আপনার আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবদের সন্তানরা সবাই হয়তো তথাকথিত ভালোকিছু নিয়ে পড়াশোনা করছে। আপনার সন্তান যদি কলা বিভাগে পড়াশোনা করে তবে তাদের কাছে আপনার মাথা নিচু হয়ে যাবে। তাই আপনি জোর করেই ভালো কিছুতে ভর্তি করেছেন। দয়া করে এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না। বাবা-মা এর একটা ভুল সিদ্ধান্ত একটি সন্তানের জীবন অন্ধকার করে দেবার জন্য যথেষ্ঠ।
৩) প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। তারা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র। তাই আপনার সন্তানের সাথে কারো তুলনা চলে না। তাই দয়া করে কারো সাথে কারো তুলনা না করে তার মধ্যেকার ভালো গুনগুলো খোজার চেষ্টা করে তার পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করুন।
৪) স্বাধীন খেলাধুলাতে সাহায্য করুন। খেয়াল রাখুন কোন ভাবেই শিশু যেন খেলাধূলা থেকে বঞ্চিত না হয়।
৫) বাবা-মা এর ঝগড়া কখনই সন্তানের সামনে আনবেন না ! তাতে সন্তান নিজেকে অসহায় মনে করে।
৬) সন্তানের কথা মন দিয়ে শুনুন। তাকে বোঝার চেষ্টা করুন। তাকে পরিবারের একজন করে তুলুন। পরিবারের সুখ-দুঃখ বুঝতে শেখান।
৭) সকলের সাথে মিশতে পারা একটা ভালোগুন। আপনার সন্তান কে সকলের সাথে মিশতে শেখান। খাবার ভাগ করে খেতে শেখান।
৮) সন্তান কোনকিছু চাইলে যে সাথে সাথেই দিতে হবে তার কোন মানে নেই ! তাকে বুঝিয়ে বলুন, ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে শেখান।
৯) কোন কিছু অস্বাভাবিক আচরণ দেখলে গুরুত্বহীন ভেবে উড়িয়ে দেবেন না। বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্য নিন।
........সমাপ্ত
"আত্মহত্যার পথে কৈশোর" প্রবন্ধটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আপনি আরো প্রবন্ধ পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। প্রবন্ধটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
©
ভালো বিষয়
ReplyDelete