উল্টো পা
![]() |
উল্টো পা - Green Vivacity |
ওহ ! ছেলেটা দেখছি পিছু ছাড়লো না। হাড্ডি সার কালো লিকলিকে সিড়িঙ্গে ছেলেটি সেই যে গুরুপদ বাবুর পিছু নিয়েছে তারপর থেকে আঠার মতো লেগে আছে। গুরুপদ বাবু রেগে গিয়ে এরপর তাকে বললেন "ব্যাটা তুই এর আগে অনেক বার ঠকিয়েছিস। আর তোকে বিশ্বাস করবো না। যা ভাগ !" ছেলেটা দেঁতো হাসি হেসে বলল "বাবু আর একটা চান্স দেন। আমি হলফ করে বলতে পারি এবার আপনি আর ঠকবেন না। যে মেয়ের খবর আমি নিয়ে এসেছি তাকে দেখলেই আপনি অবাক হয়ে যাবেন !" গুরুপদ বাবুর সদ্য পত্নী বিয়োগ হয়েছে। তাই সে বিয়ে করার জন্য একটা ভালো কম বয়সি কচি মেয়ের খোঁজ করছেন। অনেক ঘটক কে সে বলেছে। কিন্তু সবাই তাকে বিদ্রুপ করে হাসা হাসি করে। এইতো সেদিন নান্টু ঘটক বলে দিলো "মশাই বয়স্কা বিধবা টিধবা হলে বলবেন ব্যাবস্থা করে দেব ! কিন্তু আপনার জন্যে কম বয়সি কচি মেয়ের ব্যাবস্থা করা আমার পক্ষে সম্ভব না !"
গুরুপদ বাবু কয়েকদিন মনমরা হয়ে রইলেন। শেষে একদিন এই সিড়িঙ্গে ছেলেটা বাড়িতে এসে হাজির। কারো মুখে নাকি গুরুপদ বাবুর বিয়ের ইচ্ছের ব্যাপারটা সে শুনে এসেছে। কয়েকটা কম বয়সি ভালো মেয়ের খবর আছে নাকি তার কাছে। শুনেই গুরুপদ বাবু চাঙ্গা হয়ে গেলেন। সে কাজের লোককে ডেকে ছেলেটির জন্যে দই মিষ্টি আনালেন। তারপর তাকে আদর করে খাইয়ে কড়কড়ে পাঁচশ টাকা দিলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন "যাক ! এতোদিনে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন।"
তারপর গুরুপদ বাবু একের পর এক মেয়ে দেখলেন। কিন্তু কোনটাও পাতে দেওয়ার মতো নয়। বয়স কচি হলে হবে কি ! কোনটা কালো তো কোনটা খোঁড়া আবার কোনটা বোবা। গুরুপদ বাবু ছেলেটিকে রাগে কপ কপ করতে করতে বললেন "ব্যাটা এই তোর মেয়ের খোঁজ ? শালা প্রত্যেক বারেই যাওয়ার গাড়ি ভাঁড়া, মিষ্টি নিয়ে যাবার খরচ, আর তোর পাওনা, তোর বাপ দেবে না কী ? এরপর তুই যদি আমার ভিটেয় উঠিস তাহলে তোকে আমি লাথি মেরে দূর করবো ! যা ভাগ এখান থেকে !"
ছেলেটির সেই যাওয়া, এতদিন আর কোন পাত্তা ছিলো না। আজ সকালে বাজারে ছেলেটির সাথে দেখা হতেই সে গুরুপদ বাবুর পিছু নিলো। তারপরই তাকে মেয়ে দেখার জন্যে পিরাপিরি করতে লাগলো। গুরুপদ বাবু ছেলেটির কথা শুনে বলল "দেখ এই শেষ সুযোগ এরপরও যদি আগের মতো হয় তাহলে কিন্তু তোর খবর আছে !"
ছেলেটি হাত কচলে বলল সেই সুযোগ আপনি আর পাবেন না। কারন এইবার মেয়ে কে দেখে আপনার পছন্দ হবেই ! গুরুপদ বাবু বললেন "যদি পছন্দ হয় তাহলে তুই ভালো পাওনাও পাবি।" শুনে ছেলেটি বলল "সে তো জানি বাবু। তবে একটা কথা বাবু মেয়ের বাবা মা কিন্তু খুব গরীব। বেচারিরা ঠিক ঠাক ভাবে থাকতেও পারে না ! ঘর দুয়ার সব ভাঙ্গা ফুটো।" গুরুপদ বাবু বললেন "তাতে কি হয়েছে ? আমি তো আর ঘর বাড়ি কে বিয়ে করছি না ! শুধু মেয়ে যেন ভালো হয়।" সে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না বাবু। তাহলে আমরা কিন্তু কাল সকালেই রওনা দেব। আপনি রেডি হয়ে থাকবেন বাবু। আমি সকালেই আপনার বাড়ি যাচ্ছি। এই বলে ছেলেটি বাজারের ভিড়ের মধ্যে নিমেষে ধাঁ হয়ে গেল।
গুরুপদ বাবু ভোর ভোর উঠে পড়লেন। দাঁড়ি গোঁফ কেটে, চুলে কলপ লাগিয়ে, স্নান সেরে ধবধবে পোষাক পরে রেডি হয়ে বসে রইলেন। একটু পরেই ছেলেটি চলে এল। গুরুপদ বাবু তাকে এক কাপ চা খেতে দিলেন। নিজেও এক কাপ খেলেন। তারপর চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন "হ্যাঁ রে আমরা এখন যাবো কোথায় ?" শুনেই ছেলেটি বলল "ভুতুম পুর।" ওরে বাবা ! এ তো নামেই ভূত। শেষে আবার নিয়ে গিয়ে ভূত টুত দেখাবি না তো ? গুরুপদ বাবুর কথায় ছেলেটি নিজের কান ধরে জিভ কেটে বলল "এ আপনি কি বলছেন বাবু ! চলুন না গিয়ে দেখবেন একদম লক্ষী প্রতিমা।"
ঘন্টা দুয়েক বাস জার্নি করে গুরুপদ বাবুর নাভি শ্বাস উঠে গেল। এত খারাপ রাস্তা জীবনে তিনি প্রথম দেখলেন। বাসের ঝাঁকুনি তে গুরুপদ বাবুর কোমরে ব্যাথা হয়ে গেল। শেষে ভুতুম পুরে নেমে তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। প্যান্টের পকেট থেকে চিরুনি বের করে তিনি চুলটা একটু ঠিক করে নিলেন। তারপর জামা প্যান্ট গুলো ঝেড়ে নিলেন। গ্রামটার চারিদিকে চেয়ে গুরুপদ বাবুর কেমন যেন একটু খটকা লাগলো। শুধু ফাঁকা মাঠ চারধারে। আর পুরনো সব বড় বড় গাছ। মাঝে মাঝে একটা করে ঝুপড়ি বাড়ি। ছেলেটি গুরুপদ বাবুকে বলল "বাবু আসুন এই সামনেই মেয়ের বাড়ি।" গুরুপদ বাবু রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ঝুপড়ি গুলো দেখতে লাগলেন ! দেখে মনে হয় ঝুপড়ি গুলোতে অনেক দিন কেউ নেই ! গ্রামে একজন মানুষ কেও তিনি দেখতে পেলেন না ! একটু সন্দেহ হতেই তিনি ছেলেটিকে ব্যাপারটা বললেন। শুনেই ছেলেটি বলল "এখান কার লোকেরা সব চাষ বাস করে। এখন সবাই মাঠে। তাই গ্রামে লোকজন এখন একদম নেই। সব চাষে ব্যাস্ত।" গুরুপদ বাবু মনে মনে ভাবলেন তাই হবে হয় তো !
হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের শেষ প্রান্তে তারা চলে এল। জায়গাটা কেমন যেন একটু গা ছমছমে। চারদিকে বড় বড় গাছ। সামনে একটা সরু খাল। গাছের আড়ালে সূর্য্যের আলো ঢাকা পড়ে জায়গাটাতে আলো আঁধারি তৈরী হয়েছে ! কেমন যেন একটা ভৌতিক পরিবেশ। গুরুপদ বাবুর একটু ভয় ভয় করতে লাগলো ! তিনি ছেলেটি কে বললেন "ওরে ! এ তুই আমাকে কোথায় নিয়ে এলি ?" শুনেই ছেলেটি সামনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল "বাবু এই তো মেয়ের বাড়ি।" গুরুপদ বাবু বাড়িটা দেখেই আঁৎকে উঠলেন ! বাড়ির চারধারের দেওয়ালে আগাছা আর গাছ জন্মে বড় বড় ফাটল তৈরী হয়েছে।" দেওয়াল শ্যাওলার পুরু স্তরে সবুজ হয়ে আছে। এই বাড়িতে যে কোন মানুষ থাকে গুরুপদ বাবু তা ভাবতেই পারছেন না ! ছেলেটি বাড়ির সামনে গিয়ে হাঁক দিয়ে বলল "কইগো সবাই ! বাইরে এস।" হাঁক শুনেই একজন বউ ঘোমটা দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এল। একজন বুড়ি লাঠি হাতে বেড়িয়ে এল। বুড়ি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল "কইগো আমার নাত জামাই ?" ছেলেটি গুরুপদ বাবুর দিকে হাত দিয়ে ইশারা করতেই, বুড়ি ঠক ঠক করে লাঠি নিয়ে গুরুপদ বাবুর দিকে এগিয়ে গেল। তারপর তার একটা হাত ধরে বলল "আরে এস এস নাত জামাই। ভেতরে চলো। নাতনী তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। গুরুপদ বাবু একটু শুকনো হেসে বুড়ির হাত ধরে ভিতরে প্রবেশ করলেন।
ভেতরটা মোটামুটি একটু পরিপাটি। ভেতরে একটা বিছানাতে বুড়ি গুরুপদ বাবুকে বসিয়ে দিল। একটু পরেই সেই ঘোমটা দেওয়া বউটা মিষ্টি আর শরবত নিয়ে হাজির হলো। ছেলেটি গুরুপদ বাবুর পাশে এসে বসলো। গুরুপদ বাবুর কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো। আনমনে মিষ্টির প্লেট টা নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকাতেই দেখলো, সে গোগ্রাসে মিষ্টি গুলো খেয়ে যাচ্ছে।
বুড়ি গুরুপদ বাবুকে বললেন ..."এত মনমরা কেন নাত জামাই ? বুঝেছি আর তর সইছে না ! এদিকে তোমার আর ওদিকে তার। আর একটু দাঁড়াও বাছা তারপরই দুইজনে আশ মিটিয়ে দেখবে একে অপরকে।"
হলুদ শাড়ি পড়ে মেয়েটি যখন গুরুপদ বাবুর সামনে এল, তাকে দেখেই তিনি মোহিত হয়ে গেলেন। সাথে সাথে তার মন ভাল হয়ে গেল। কি অপূর্ব দেখতে ! সত্যি ছোঁড়াটা এতদিনে একটা কাজের মতো কাজ করেছে। মেয়েটি গুরুপদ বাবুর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসতে লাগলো।
এরপর বুড়ি বলল... "দেখো নাত জামাই আমাদের মেয়ের কিন্তু কোন খুঁত নেই ! ঐ পায়ে যা একটু সমস্যা আছে।" বুড়ি বলা মাত্র মেয়েটি হঠাৎ রেগে উঠে বুড়ির দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলো। বুড়ির হাব ভাবে বোঝা গেল তার মুখ ফস্কে কথাটা বেড়িয়ে গেছে। আর যায় কোথায় ! গুরুপদ বাবু এতক্ষণ মেয়েটির পায়ের দিকে লক্ষ্য করেন নি ! বুড়ি বলা মাত্র তিনি মেয়েটির পায়ের দিকে তাকাতেই, তার পিলে চমকে উঠলো ! ভয়ে গোটা শরীর দিয়ে তার দরদর করে ঘাম ঝরতে লাগলো। গুরুপদ বাবু স্পষ্ট দেখলেন মেয়েটির দুটো পা ই উল্টো দিকে ঘোরানো । ভয়ে তিনি ভির্মি খেলেন। তারপরই উর্দ্ধশ্বাসে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেদিক সামনে পেলেন সেই দিকেই ভূত ভূত করে দৌড় লাগালেন। পেছন থেকে নাকি সুরে কিছু কথা তার কানে ভেঁসে এল "বুঁড়ি তোকে আমি চিবিয়ে খাবো। তুই আমার বিয়েটা ভেস্তে দিলি !" এই শুনে গুরুপদ বাবু দৌড় আরো বাড়িয়ে দিলেন। কিছুটা যাওয়ার পরই সামনে থাকা সেই খালের কাদার মধ্যে পড়ে গেলেন ! এখন তিনি নিজেই কাদা মেখে ভূত হয়ে "ভূত ভূত" করে চিৎকার করতে লাগলেন। হঠাৎ তার সামনে সেই ছেলেটা উদয় হলো ! "বাবু সাবধানে" বলে হাঁক দিলো। গুরুপদ বাবু ছেলেটির 'পায়ের দিকে' তাকিয়ে আর সহ্য করতে পারলেন না। একদম চোখ উল্টে জ্ঞান হারিয়ে চিৎপটাং হয়ে আবার কাদায় পড়লেন !
........সমাপ্ত
"উল্টো পা" গল্পটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা কিন্তু আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আপনি আরো গল্প পড়তে আমাকে অনুসরণ করতে পারেন। গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহেদী হাসান পিয়াস
©
No comments